সুন্দরবন ঘেঁষে ৩২০টি শিল্পকারখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় পরিবেশ কমিটি। ১৯৯৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করলেও তার বরখেলাপ করে এসব শিল্পকারখানার অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে পরিবেশবিদরা অভিযোগ করেছেন। জাতীয় পরিবেশ কমিটি দেশের শিল্পায়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে এসব কারখানাকে অনুমোদন দিয়েছে। যদিও এসব এলকায় কলকারখানাসহ যেকোনো উন্নয়নকাজ করার আগে বন বনের প্রাণীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন শর্ত দিয়ে বিধি করা হয়েছে। অথচ বিদ্যমান শিল্পকারখানার পাশাপাশি নতুন করে ১৬টি শিল্পকারখানাকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮টি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বোতলজাত করার কারখানা, যা মারাত্মক দূষণকারী বা লাল তালিকাভূক্ত হিসেবে বিবেচিত। বাকি ৮টি বড় ও মাঝারি আকৃতির শিল্পকারখানা। পরিবেশবিদরা মনে করছেন, নতুন করে এসব শিল্পকারখানার অনুমোদন সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। যতই বন ও বনের প্রাণীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শর্তের কথা বলা হোক, তাতে কোনো কাজ হবে না। সুন্দরবনকে ঘিরে শিল্পকারখানা গড়ে উঠার অর্থই হচ্ছে, এর ক্ষতিসাধন।
বাংলাদেশের গর্ব করার মতো যে কয়টি প্রাকৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, তার মধ্যে সুন্দরবন অন্যতম। ইউনেস্কো এই বনকে অনেক আগেই ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাণীকূল রক্ষার তাকিদ বরাবরই প্রতিষ্ঠানটি দিয়ে আসছে। এটি শুধু বাংলাদেশেরই সম্পদ নয়, বিশ্বেরও সম্পদ। দেশকে ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করার অন্যতম প্রাকৃতিক বুহ্য। দুঃখের বিষয়, বনটির ক্ষতি হয়, এমন অপকর্ম দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক এবং এর বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিক সমাজ আন্দোলন পর্যন্ত করছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের কী ধরনের ক্ষতি হবে তার বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত তারা তুলে ধরেছে। অন্যদিকে সরকারও বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বদ্ধপরিকর এবং তার নির্মাণ কাজ শুরু করে দিয়েছে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে কয়েকশ’ শিল্পকারখানা গড়ে তোলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে যার মধ্যে মারাত্মক দূষণকারী কারখানাও রয়েছে। এসব কারখানা চালু হলে সুন্দরবন যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তাতে সন্দেহ নেই। যতই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হোক না কেন, অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটলে এর প্রভাব যে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর যে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। দুর্ঘটনা না ঘটার গ্যারান্টি তো সরকার দিতে পারবে না। যেহেতু এই গ্যারান্টি নেই, তাই সুন্দরবন এলাকায় শিল্পকারখানার অনুমোদন দেয়া উচিত হচ্ছে না। এ ধরনের অনুমোদন আত্মঘাতি। আমরা দেখেছি, কয়েক বছর আগে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে শ্যালা নদীতে অপরিশোধিত তেলবাহী জাহাজ ডুবে তেল ছড়িয়ে যাওয়ায় কী ভয়াবহ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বৃক্ষরাজির ক্ষতি সাধনের পাশাপাশি নদীর মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। অনুমোদনপ্রাপ্ত শত শত শিল্পকারখানা যখন পূর্নোদ্যমে চালু হবে, তখন সেগুলো থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত ধোঁয়া ও কেমিক্যাল অবশ্যই সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে। এ ক্ষতি তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো দৃষ্টিগোচর হবে না, তবে বছরের পর বছর ধরে নিঃসরিত হতে থাকা ক্ষতিকর এসব উপাদানের প্রভাব সুন্দরবনের উপর নিশ্চিতভাবেই পড়বে। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী শিল্পকারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে যে যুক্তি দিয়েছেন, তা ধারণাপ্রসূত। তিনি বলেছেন, ইউনেসকো যেহেতু রামপালের ব্যাপারে তার আপত্তি তুলে নিয়েছে, তাই অন্যান্য শিল্পকারখানার ব্যাপারেও তার আপত্তি নেই বলে আমরা মনে করছি। মন্ত্রীর এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। রামপালের ব্যাপারে ইউনেস্কোসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থা বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সায় দিয়েছে। অন্যান্য শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে কি পড়বে না, এ ধরনের কোনো নিরীক্ষা ইউনেস্কো করেনি। তাই কেবল ধারণার উপর ভিত্তি করে কলকারখানা স্থাপনের অনুমতি দেয়া কোনোভাবেই সঠিক নয়। সুন্দরবন নিয়ে সরকারের নীতির সঙ্গেও এ সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক।
দেশে কলকারখানা স্থাপন, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে এজন্য কেবল সুন্দরবন এলাকাকেই কেন বেছে নিতে হবে? সুন্দরবন ঘেঁষে যেসব কলকারখানা স্থাপন ও চালুর অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেগুলো দেশের অন্যান্য স্থানে করা অসম্ভব কিছু নয়। আমরা মনে করি, সুন্দরবনের অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। এ কথা মনে রাখা দরকার, শিল্পকারখানা যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে স্থাপন করা যেতে পারে। সুন্দরবনের ক্ষতি বা ধ্বংস হলে আরেকটি সুন্দরবন সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এ বন নিয়ে সচেতন ও সাধারণ মানুষের যে আবেগ ও মমতা প্রকাশিত হচ্ছে, তা সরকারের বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। যেসব শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেগুলো সুন্দরবনের পরিবেশ কীভাবে রক্ষা করবে, তার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। কেবল মৌখিকভাবে পরিবেশ রক্ষার শর্তের কথা বলা হচ্ছে। এসব শর্ত কতটা কীভাবে পালিত হবে এবং কারা মনিটর করবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। এরকম অনিশ্চিত ও অনিরাপত্তামূলক পরিস্থিতিতে যদি শিল্পকারখানাগুলো চালু হয়, তবে এগুলো সুন্দরবনের জন্য ফাঁস হয়েই থাকবে। সুন্দরবন ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠবে। এ বিবেচনায় সুন্দরবন ঘেঁষে নতুন কোনো শিল্পকারখানার অনুমোদন দেয়া সমীচিন হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন