সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ফের বন্যার কবলে দেশ

| প্রকাশের সময় : ১৪ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ভারি বর্ষন ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে, হাজার হাজার হেক্টরের আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, কয়েকশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে, বহু মানুষ বাঁধ, রাস্তা বা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১৪টি জেলা মারাত্মকভাবে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, লালমনিহাট, কুড়িগ্রাম গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁ, সিরাজগঞ্জ এবং পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নীচে চলে গেছে। যমুনা, তিস্তা ও সুরমাসহ অন্তত ১৫ নদীর পানি বিপদ-সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ার আশংকা প্রবল। অবিরাম বৃষ্টি তো আছেই, সেইসঙ্গে সীমান্তের ওপর থেকে প্রবল বেগে নেমে আসছে ঢল। খবর পাওয়া গেছে, ভারত গজলডোবা বাঁধের সব গেট উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। ওদিকে নেপালেও ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। ভারত সীমান্তবর্তী নেপালের তিরাই অঞ্চলে বন্যায় প্রাণহানিসহ ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবহাওয়াবিদরা আগেই এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, যা সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা, নেপাল কিংবা ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে অতিবৃষ্টি ও বন্যা দেখা দিলে বাংলাদেশে বন্যা হওয়া অবধারিত। বাংলাদেশ ভাটিতে অবস্থান করায় বন্যা থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় তার নেই। এক্ষেত্রে অত্যন্ত দু:খজনক একটি ব্যাপার এই যে, উজানে বন্যা দেখা দিলে ভারত অভিন্ন নদীগুলোতে দেয়া বাঁধগুলোর সব গেইট একযোগে খুলে দেয়। ফলে একযোগে বিপুল পানিরাশি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে এবং আশঙ্কার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিসাধন করে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাঁধগুলো খুলে দেয়ার বিষয়ে ভারত কখনোই বাংলাদেশকে আগামবার্তা দেয়না এবং বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এটি বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন বোধ করে না।
এপ্রিল মাসে প্রথম বন্যা আঘাত হানে সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। ওই বন্যায় হাওরগুলোর উঠতি বোরো ধান প্রায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। জানা যায়, অন্যান্য ক্ষতির বাইরে শুধুমাত্র ধানের উৎপাদনক্ষতি হয়েছে ১০ লাখ টনের ওপরে। সেই বন্যা ও ক্ষয়ক্ষতিরও মূল কারণ ছিল অবিরাম ভারি বর্ষণ ও সীমান্তের ওপর থেকে আসা ঢল। এরপর এযাবৎ উত্তরাঞ্চল, ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক দফায় বন্যা হয়েছে এবং বাড়িঘর, আবাদ-উৎপাদন ও রাস্তাঘাট ইত্যাদির নানা মাত্রায় ক্ষতি হয়েছে। বিগত কয়েক মাসে বন্যায় সামগ্রিকভাবে যে ক্ষতি হয়েছে তা একটা বিরাট ক্ষতি এবং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নানা ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। মানুষের বন্যাজনিত দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা তো আছেই, একই সঙ্গে অনিবার্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম আকাশ ছুঁয়েছে। মোটা চালের দাম বাড়তে বাড়তে প্রতি কেজি ৫০ টাকায় উঠেছে। চিকন ও সরু চালের দাম উঠেছে ৬০ টাকায়। চালের দামে এটা রেকর্ড। সরকার বন্যাদুর্গত মানুষের সেবা ও ত্রাণে যেমন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তেমনি চালের বাজার নিয়ন্ত্রণেও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারী গুদামে চালের পর্যাপ্ত মজুদ না থাকার কারণে সরকার চালের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে পারেনি। এমনকি আমদানী উন্মুক্ত করে দেয়ার পরও এখনো বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তার ক্রয়সীমার মধ্যে আছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের, এমতাবস্থায়, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তারা অসহায় ও দিশাহারা হয়ে পড়েছে।
নতুন করে দেখা দেয়া বন্যা বড় রকমের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অত:পর বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে কী হবে, সহজেই আন্দাজ করা যায়। আমরা এর আগে বিভিন্ন উপলক্ষে বলেছি, বন্যা পরিস্থিতি ও বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, উদ্যোগ, ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার এ ব্যাপারে কতদূর কি করেছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোই বলতে পারে। বন্যা কবলিত এলাকায় শুরুতেই উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা, আশ্রয় শিবির খোলা এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ আশু বা জরুরি হয়ে দেখা দেয়। এ ব্যাপারে উপযুক্ত প্রস্তুতি ও আয়োজন না থাকলে মানুষের দুর্ভোগ-বিপর্যয় চরমে ওঠে। সেটা আমরা এবারও লক্ষ্য করেছি। এর পরের কাজ হলো, গৃহ ও কৃষি পুনর্বাসন। এই সঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত দুর্গত মানুষের সহায়তা দেয়া। আমরা জানিনা, এসব এ ব্যাপারে কতটা প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও কার্যব্যবস্থা সরকার নিয়েছে। বন্যা আমাদের দেশে নতুন কোনো দুর্যোগ নয়। ভৌগলিক অবস্থানগত এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত কারণে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও বন্যা এখানে প্রতি বছরের সাধারণ ঘটনা। সীমান্তের ওপর থেকে আসা বা ঠেলে দেয়া পানি বন্যার প্রকোপ ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দেয়। বন্যা একেবারে নিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে তা সহনযোগ্য পর্যায়ে রাখা সম্ভব যদি বন্যারোধক ব্যবস্থাসহ বন্যাকালীন ও বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা থাকে। আমরা আশা করি, সরকার চলমান বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। দ্রুত দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন