বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

এ আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়

প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ধারাবাহিকভাবে পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়া নিয়ে বিগত কয়েক মাস ধরে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। আইনের লোকের দ্বারা বেআইনি কাজ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের ধারাবাহিক এ প্রবণতায় সচেতন মহল যেমন স্তম্ভিত ও উদ্বিগ্ন, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। কে কখন পুলিশের ওই শ্রেণীটির দ্বারা আক্রান্ত হবে, এমন অনিশ্চয়তা তাদের মধ্যে রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জনসাধারণের আইনের সহযোগিতা ও ভরসার স্থল যে পুলিশ বাহিনী, তার কিছু সদস্য যদি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, তাহলে তারা কোথায় যাবে, কার কাছে সাহায্য কামনা করবে? পুলিশের একশ্রেণীর সদস্য কর্তৃক সাধারণ মানুষের নিপীড়নের শিকার হওয়ার এক ধরনের অভিযোগ বরাবরই ছিল। তবে তা ব্যতিক্রম হিসেবেই পরিচিত ছিল। সহনীয় মাত্রায় ছিল। বিগত কয়েক বছরে এ মাত্রা যেন সীমাছাড়া হয়ে পড়েছে। পুলিশ যেন এখন সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের আতঙ্ক না হয়ে সাধারণ মানুষের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। তারা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পেতে গিয়ে যে পুলিশের কাছে প্রতিকার চাইবে, সেই পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর কারণে তারা আরও বিপদে পড়ছে। বিষয়টি অনেকটা পানিতে কুমীর, ডাঙ্গায় বাঘের পর্যায়ে চলে গেছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাধারণ মানুষ পথে-ঘাটে স্বাভাবিকভাবে চলতে গিয়েও পুলিশের একটি শ্রেণীর অনাহূত হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আমরা দেখেছি, গত ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে আটক করে হত্যার হুমকি দিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করতে ৩১ জানুয়ারি রাতে তল্লাশির নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করতে, ৩ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে এক ফুটপাতের দোকানদারের কাছে চাঁদা চেয়ে না পেয়ে তাকে অগ্নিদগ্ধ করতে, ৭ ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ী থানায় ওসির বিরুদ্ধে নারী লাঞ্ছনার অভিযোগ উঠতে। এমন অসংখ্য ঘটনাই প্রতিনিয়ত পুলিশের ওই শ্রেণীটির দ্বারা ঘটে চলেছে। সব খবর পত্র-পত্রিকায় আসে না। সর্বশেষ ডিশ বিল চাইতে গিয়ে গত শুক্রবার খিলগাঁওয়ে বংশাল থানার এক এএসআই কর্তৃক ক্যাবল অপারেটরকে গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছে। ক্যাবল অপারেটরের অপরাধ সে কয়েক মাসের বকেয়া বিল এএসআইয়ের কাছে চাইতে গিয়ে না পেয়ে ডিশলাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এ নিয়ে অপারেটরের সাথে তর্কাতর্কি, মারধর এবং একপর্যায়ে এএসআই তাকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এএসআইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশের এ শ্রেণীটি কেন ধারাবাহিকভাবে একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে? কেন তাদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না?
আমরা জানি, পুলিশ বিভাগে সৎ, দক্ষ ও জনবান্ধব সদস্য সংখ্যাই বেশি। তারা প্রকৃত অর্থেই অপরাধীর শত্রু এবং সাধারণ মানুষের বন্ধু হতে চান এবং সেভাবেই কাজ করার আকাক্সক্ষা পোষণ করেন। চেইন অব কমান্ডকে তারা অত্যন্ত মান্য করে চলেন। ‘শান্তি শপথে বলীয়ান’ হওয়ার আদর্শই তারা ধারণ করেন। পরিতাপের বিষয়, এসবই প- হয়ে যাচ্ছে কিছু সংখ্যক পুলিশের বেপরোয়া আচরণ এবং অপরাধমূলক বিভিন্ন কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে। এই শ্রেণীর পুলিশই পুরো পুলিশ বিভাগের ‘কলঙ্ক তিলক’ হয়ে আছে। এমনিতেই খুব বেশি ঠেকায় না পড়লে সাধারণ মানুষ পুলিশের দ্বারস্থ হতে চায় না। তার ওপর ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ও দুর্বৃত্ত মানসিকতা পোষণকারী পুলিশের ভয়াবহ অপরাধমূলক ঘটনা দেখে সাধারণ মানুষ আরও ভীত হয়ে পড়েছে। পুলিশকে ভরসার প্রতীক মনে না করে, ভয়ের প্রতীক মনে করারÑএই চিন্তা কবে দূর হবে, কবে সাধারণ মানুষ পুলিশকে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করবে, তা আমরা জানি না। পুলিশের প্রতি এ ধারণা কি যুগের পর যুগ চলতেই থাকবে? আমরা প্রায়ই পুলিশের ভাবমর্যাদা ফিরিয়ে আনতে আপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা শুনি। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ নিয়ে চিন্তাভাবনাও করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ তো প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল একটি বাহিনী। এ বাহিনীর ভাবমর্যাদা ফিরিয়ে আনার চিন্তা ও অপরাধী সদস্যদের শাস্তির প্রসঙ্গটি আসবে কেন? পুলিশ মানুষ, সেও ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়, এ কথা ধরে নিয়েও তো বলা যায়, ইচ্ছাকৃত ভুল বা অপরাধে জড়িয়ে পড়া কোনো ভুল হতে পারে না। যেসব ঘটনার কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো যে ইচ্ছাকৃত ছিল তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এমনকি যে ক্যাবল অপারেটরকে গুলি করা হয়েছে, তাও কোনো ভুল ছিল না। মাসের পর মাস ডিশ বিল দেবে না এবং লাইন কেটে দিলে মারধর ও পিস্তল দিয়ে গুলি করা নিশ্চিতভাবেই কোনো ভুল হতে পারে না। পাশাপাশি ডিউটি চলাকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া ওই এএসআইয়ের এলাকার বাইরে চালে যাওয়াও কোনো নিয়মের মধ্যে পড়ে না। এ ধরনের আচরণ যে ¯্রফে ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া কিছুই নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পুলিশের এ শ্রেণীর সদস্যকে কেন চেইন অব কমান্ডে আনা যাচ্ছে না, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। বহুদিন ধরেই বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মোকাবিলার কাজে অধিক ব্যবহারের ফলে পুলিশের একটি শ্রেণীর মধ্যে এ ধারণা জন্মেছে, তারাই সরকার টিকিয়ে রেখেছে। কাজেই তারা খেয়াল-খুশিমতো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটালেও, সরকার তাদের কিছু করবে না। এ মানসিকতার কারণে এ শ্রেণীটির মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রবণতার রাশ যদি টেনে ধরা না যায়, তবে সাধারণ মানুষকে প্রতি পদেই নাজেহাল ও নিপীড়নের শিকার হতে হবে।
অপরাধমূলক ঘটনা প্রতিহত ও অপরাধী দমনে আমাদের পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আমরা দেখেছি, অনেক জটিল ও কঠিনতম ঘটনা উদঘাটন এবং অপরাধীকে গ্রেফতারে পুলিশ বাহিনী অনন্য সাফল্য দেখিয়েছে। দুঃখের বিষয়, এ বাহিনীর কিছু সদস্যের অপরাধমূলক কর্মকা- পুলিশের পুরো ভাবমর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। ভালো কাজকে মন্দ কাজ দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে। এর দায়ভার পুরো পুলিশ বাহিনীকেই নিতে হচ্ছে। যে সৎ ও দক্ষ সদস্য, তারই সহকর্মীর অপরাধের দায়ও তার ওপর এসে পড়ছে। আমরা মনে করি, দুর্ধর্ষ অপরাধী ও জটিল ঘটনা যে দক্ষতা ও আপসহীনতায় পুলিশ দমন ও উদঘাটন করে, একই মনোভাব দেখিয়ে অপরাধপ্রবণ ও অপরাধের সাথে যুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। লোকদেখানো সাময়িক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, সাধারণ অপরাধীর অপরাধ যেভাবে বিবেচনা এবং শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, একইভাবে অপরাধী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুলিশকে জনবান্ধব ও ভরসার স্থল হিসেবে পরিণত করতে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। সাধারণ মানুষের বন্ধু ও অপরাধীর শত্রু - পুলিশের এমন মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন