মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ আবদুচ্ছমদ
॥ এক ॥
জুমার দিন গোসল করা সুন্নত নাকি ওয়াজিব?
উত্তর : মাযহাবের ইমামগণের মতামত : (১) ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম শাফেয়ী (রহ.), ইমাম আহমদ (রহ.) এবং অধিকাংশ ইসলামী ফকিহগণের মতে জুমার দিন গোসল করা সুন্নত।
(২) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর অপর মতে, দিনমজুর এবং শ্রমিকদের জন্য জুমার দিন গোসল করা ওয়াজিব, আর যারা দিনমজুর বা শ্রমিক শ্রেণী নয় তাদের জন্য সুন্নত।
দলিল : হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, দিনমজুর এবং শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরা তাদের ঘর্মাক্ত এবং ময়লাযুক্ত কাপড় নিয়ে জুমার দিন মসজিদে নববীর মধ্যে আসত। আর মসজিদে নববী তখন আয়তনে ছোট ছিল। তাদের শরীরের ঘামের দুর্গন্ধে অন্যান্য নামাজির কষ্ট হতো। এই জন্য রাসূল (সা.) গোসল করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং উপরোক্ত ঘটনা থেকে এই কথা উপলব্ধি হলো যে, বাহ্যিক কারণে রাসূল (সা.) জুমার দিন গোসল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যখন বাহ্যিক কারণটি থাকল না তখন হুকুমের আবশ্যকিতাও থাকবে না। ইহা দ্বারা এ কথাও পরিষ্কার হলো যে, ইমাম আহমদ (রহ.)-এর মতেও জুমার দিন গোসল করা সুন্নত।
(৩) আসহাবে জাহেরের মতে, জুমার দিন গোসল করা ওয়াজিব।
তাদের দলিল হলো : (১) হযরত আবু সাঈদ খুদুরী (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন যে, জুমার দিন প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের জন্য গোসল করা ওয়াজিব। বুখারি শরিফ ১ম খ- পৃষ্ঠা ১২০ থেকে ১২১ পর্যন্ত, মুসলিম শরিফ ১ম খ- ২০৮ পৃষ্ঠা।
(২) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন যে, যখন তোমাদের মধ্যে হতে কোনো ব্যক্তি জুমার নামাজের জন্য আসে, অর্থাৎ ইচ্ছা পোষণ করে তখন সে যেন গোসল করে নেয়। (বুখারি শরিফ ১খ- ১২০ পৃষ্ঠা, মুসলিম শরিফ ১ম খ- ২৮১ পৃষ্ঠা, তিরমিজি শরিফ ৬৫ পৃষ্ঠা ও নাসারি শরিফ ইবনে মাজা শরিফ)
অধিকাংশ ফকিহগণের দলিল:-
(১) হযরত সামুরা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন অজু করল তা ভালো করেছে, আর যে ব্যক্তি গোসল করল, গোসল করা উত্তম, (তিরমিজি ১ম খ-, পৃষ্ঠা ৬৫ থেকে ৬৬ পর্যন্ত।)
(২) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত ওমর (রা.) জুমার দিন খুতবায় দাঁড়িয়েছিলেন, এমতাবস্থায় নবী করিম (সা.)-এর প্রথম সারির মুহাজির সাহাবিদের একজন সাহাবি (হযরত ওসমান (রা.) উপস্থিত হলেন। হযরত ওমর (রা.) খুতবারত অবস্থায় তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আসার এটাই কি সময়? তিনি উত্তরে বলেন, আমি কাজে ব্যস্ত ছিলাম, আমি ঘরে যাইনি, আমি আজান শোনামাত্রই অজু ব্যতীত অন্য কোনো কিছু (গোসল) করিনি। হযরত ওমর (রা.) তাঁকে বলেন, আপনি শুধু অজু যথেষ্ট মনে করলেন, অথচ আপনার কি জানা আছে? যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) (জুমার দিন) গোসল করার নির্দেশ দিয়েছেন। বুখারি শরিফে ৮৪১নং হাদিসে হযরত ওমর (রা.)-এর খুতবা উল্লেখ আছে, হযরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে খুতবার সময় যার সঙ্গে কথোপকথন হয়েছিল তিনি হলেন হযরত ওসমান (রা.)। হযরত ওমর (রা.) হযরত ওসমান (রা.)-কে দেরির কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু গোসল করার নির্দেশ দেননি। যদি জুমার দিন গোসল ওয়াজিব হতো তাহলে হযরত ওসমান (রা.) কখনো গোসল ত্যাগ করতেন না। আর হযরত ওমর (রা.)ও তাঁকে পুনরায় গোসল করে আসার নির্দেশ দিতেন।
(৩) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এবং অন্যদের হাদিসের মধ্যে জুমার দিন গোসল করার স্বয়ং কারণ বর্ণিত আছে, সুতরাং যখন কারণ অবশিষ্ট নেই তখন ওয়াজিবের হুকুমটি কীভাবে অবশিষ্ট থাকবে?
গোসল ওয়াজিব হওয়ার মতো পোষণকারী যেসব দলিল উপস্থাপন করেছেন, তার উত্তর হলো প্রথমে জুমার দিন গোসল করা ওয়াজিব ছিল বাহ্যিক কারণে, যখন বাহ্যিক কারণটি শেষ হয়ে গেছে তখন এর হুকুমটিও শেষ হয়ে গেছে।
মোট কথা : জুমার দিন গোসল করা সুন্নত।
জুমার দিন খুতবা প্রদানকালে তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামাজ পড়ার হুকুম কি?
উত্তর : জুমার দিন ইমাম খুতবা দেওয়ার সময় তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামাজ পড়া নিয়ে ফকিহগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
মাযহাবের ইমামগণের মতে : (১) ইমাম শাফেয়ী ইমাম আহমদ এবং ইসহাক (রহ.)-দের মতে, জুমার খুতবার সময় দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ পড়া মুসতাহাব। (যেমনÑ এ সম্পর্কে ইমাম নববী (রহ.) শরহে মুসলিম ১ম খ-ে ২৮৭ পৃ. আলোচনা করেছেন) এটি ইমাম বুখারিরও অভিমত।
তাঁদের দলিল : হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন এক ব্যক্তি (সালিক গাতফান (রা.)) এমন সময় মসজিদে নববীর মধ্যে এসেছেন যখন নবী করিম (সা.) জুমার খুতবা পড়তেছেন। তখন নবী করিম (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে অমুক ব্যক্তি, তুমি কি নামাজ পড়েছ?
তখন ওই সাহাবি উত্তর দিলেন না ইয়া রাসূলুল্লাহ, তখন নবী করিম (সা.) তাঁকে বললেন, তাহলে তুমি দাঁড়াও এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নাও।
(২) ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, সুরী এবং লাইস ইবনে সাঈদ (রহ.)-দের মতে, জুমার খুতবার সময় কোনো রকম কথা বলা এবং নামাজ পড়া জায়েজ নেই।
আর এটিই অধিকাংশ সাহাবা, তাবেয়িদের অভিমত। আর বর্ণনাটি হযরত ওমর হযরত ওসমান হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত : (শরহে নববী ২৮৭ পৃষ্ঠা) উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হলো যে, এই মাসালাটি হযরত ইমাম বুখারি (রহ.) ইমাম শাফেয়ী (রা.)-এর অনুসরণ করেছেন। হানাফী মাযহাবের দলিল :
১। আল্লাহর বাণী : (সুরা আরাফ আয়াত নং ২০৪) এই কথা প্রকাশ্য যে, যখন কোরআন পড়া হয় তখন মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং অন্তর দিয়ে শোনা জরুরি।
২। রাসূলের হাদিস : সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (রা.)-কে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) সংবাদ দিয়েছেন যে, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, জুমার দিন খুতবার সময় যখন তোমরা তোমাদের সঙ্গীদের বলবেÑ চুপ থাক, তখন তোমরা একটি অযথা কথা বলেছ। (বুখারি ১ম খ- পৃষ্ঠা ১২৮) উক্ত হাদিসে রাসূল (সা.) সৎ কাজের আদেশ দেওয়া থেকে নিষেধ করেছেন, অথচ সৎ কাজের আদেশ দেওয়া ফরজ। এবং তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামাজ মুস্তাহাব। এ কারণে খুতবার সময় তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামাজ অধিকতর নিষেধ।
৩। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন : ইমাম সাহেব যখন খুতবাদানের উদ্দেশে হুযুরা থেকে বের হবেন তখন কোনো নামাজ এবং কোনো কথা বলা চলবে না।
৪। মালেকী মাযহাবের আলেমগণের মতে, মদিনাবাসীদের এই আলম পরিত্যাজ্য।
৫। ইমাম নববী (রহ.) কাযী আয়াজ থেকে বর্ণনা করেছেন, হযরত ওমর, হযরত ওসমান, হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত যে, খুতবার সময় দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামাজ আদায় করতে নিষেধ করেছেন।
ইমাম শাফেরী ও ইমাম আহমদের হাদিসের জবাব : ১। রাসূল (সা.)-এর খুতবার সময় যে লোকটি এসছিলেন তাঁর নাম হলো সালিক গাতফানী (রা.)। তিনি যখন এসেছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) খুতবা শুরু করেননি। যার প্রমাণ হলো সহিহ মুসলিম শরিফের ২৮৭ পৃষ্ঠায় একটি বর্ণনায় শব্দগত এভাবে এসেছে যে, একদা হযরত সালিক আল গাতফানী জুমার দিন মসজিদে নববীতে এলেন, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) মিম্বারের ওপর বসা ছিলেন।
জ্ঞাতব্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা মিম্বারের ওপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। সুতরাং বসা দ্বারা বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এখনো খুতবা শুরু করেননি। এ কারণে খুতবার মধ্যে মনোযোগ দিয়ে শোনার হুকুম রহিত হয়ে গেছে। সুতরাং আর কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন