রাজধানীর সকল অস্থায়ী পশুর হাট সরকার দলের নেতা কর্মীদের দখলে। সিন্ডিকেট তৈরী করে নামমাত্র মূল্যে ২২টি হাটের মধ্যে ২১টি কোরবানীর পশুর হাট আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অংগ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিয়ে গেছে। কাক্সিক্ষত দর না পওয়ায় আরমানীটোলা হাটের ইজারা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বাতিল করেছে বলে জানা গেছে। এদিকে ঈদের এখনও ১০ দিন বাকি থাকলেও গতকাল বুধবার বিভিন্ন হাট থেকে প্রাপ্ত খবরে ও সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বৈধ ও অবৈধ হাটগুলো প্রস্তুত এবং কোরবানীর পশু বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে। বৈধ-অবৈধ সবক’টি হাটেই কোরবানীর পশু উঠেছে।
এ বছর পছন্দের প্রার্থীকে হাট ইজারা দেয়ার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নানা কৌশল আবলম্বন করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ হাটের টেন্ডার আহ্বান করা হলেও শেষ পর্যন্ত ৯টি হাট চূড়ান্ত করা গেছে। একটি হাট বাতিল ও তিনটি হাট ইজারা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, ডিএসসিসি’র খোদ মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তাসহ সরকার দলীয় কিছু নেতার যোগসাজশে টেন্ডার আহ্বান করা হাটগুলোর কাক্সিক্ষত দর পায়ওয়া যায়নি। অন্যদিকে উল্লেখিত কর্তকর্তারা বৈধ হাট ইজারা দেয়ার চাইতে বেশি মনোযোগী ছিলেন অবৈধ হাট ইজারা দেয়ার কাজে। এ নিয়ে গত প্রায় ১০/১২ দিন ধরে ডিএসসিসি’র নগর ভবনের মেয়র সেল ও প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার দপ্তর ছিল সরগরম। যে কারণে এবছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন শুধু কোনবানির হাট ইজারা থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাতে বসেছে।
গতকাল বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর প্রায় সবকটি হাটই প্রস্তুত। যদিও ঈদের এখনও ১০ দিন বাকি। তবে যেসব হাট বৈধভাবে ইজারা পেয়েছে সে হাটের সাথে সাথে অবৈধ হাটগুলোতেও গতকাল কোরবানির পশু তুলতে দেখা গেছে।
অস্থায়ী কোরবানির হাট বসানো সরকারি নিয়ম ঈদের দিনসহ মোট ৪ দিন। আর হাট প্রস্তুতির কাজ শুরু করবে তার ২ দিন আগে থেকে। অথচ এ বছর ঈদে ১০ দিন আগেই হাটে পশু বেচাকেনা শুরু হছে গেছে। এতো আগে থেকে কেন হাট বসানো হল জানতে চাইলে দনিয়া হাটের ইজারাদার বলেন, উত্তরাঞ্চলে বন্যার করণে তারা এ বছর আগে থেকে গরু নিয়ে ঢাকায় চলে আসা শুরু করেছে। তাই আমাদেরকেও এ বছর একটু আগে থেকেই কাজ শুরু করতে হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, ডিএসসিসি এলাকায় কোন অবৈধ হাট বসতে দেয়া হবে না। কিছু এলাকায় অবৈধ হাট বসানোর প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চলছে বলে শুনেছি। সেসব এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ হাট উচ্ছেদ করা হবে। তিনি বলেন, যে ইজারাদার সময়ের আগে হাট বসানোর কাজ শুরু করবে আমরা তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিব।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অনুমতিহীন অবৈধভাবে কমপক্ষে ১০টি পশুর হাট বসানোর প্রস্তুতি নিয়েছে স্থানীয় নেতাকর্মীরা। আশ্চর্যের বিষয় হলো দেশে সব কিছুর দাম গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেলেও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কোরবানীর পশুর হাটের ইজারা মূল্য বাড়েনি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে ঘুরে ফিরে একই সিন্ডিকেটের সদস্যরা কোরবানীর পশুর হাটের ইজারা পাচ্ছেন। তবে অন্যান্য বছর ইজারা পেতে প্রতিযোগিতা হলেও এবার আপোষ মীমাংসার মাধ্যমে তুলনামূলক কম মূল্যে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ভাগভাটয়ারা করে ইজারা দেয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সিটি কর্পোরেশনের বড় বড় কর্মকর্তারা ডেকে এনে সরকার দলীয় নেতা কর্মীদের কোরবানী পশুর হাটগুলো নামমাত্র মূল্যে ইজারা দেয়ার ব্যবস্থা করছে। যাতে তারা সরকারের কাছে নিজেদেরকে আস্থাভাজন কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিতে পারেন। শুধু তাই নয়, নির্ধারিত সময়ের আগেই এসব হাট দখল করে নিচ্ছে ইজারাদারেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর আফতাবনগর হাটের বিপরীতে মাত্র তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। সাধারণ ইজারাদারদের দরপত্র কিনতে বাধা দিয়ে একটি প্রভাবশালী চক্র পছন্দমতো দরে ইজারাও পেয়ে যায়। কাগজ-কলমে এবার হাটটি পেয়েছেন বাড্ডা আনন্দনগরের আবদুল আউয়ালের ছেলে আবদুর রহমান রুবেল। তিনি আগে বাড্ডা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মূলত ফারুকই কয়েক বছর ধরে আফতাবনগর হাটটির নিয়ন্ত্রক। তাদের বাইরে দু’জন অতীতে হাটটি ইজারা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দু’জনই খুন হয়েছেন। এ হাটের সঙ্গে সস্পৃক্তদের সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও অনুসারী। অবশ্য ‘ভাগ্নে ফারুক’খ্যাত সেই ফারুকের দাবি, তিনি হাটের সঙ্গে নেই। রুবেল হাটটি নিয়েছে।
স্থানীয়রা আরও জানান, রাজধানীর সবচেয়ে বড় এই হাটটি এক সময় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হতো। উত্তর সিটি কর্পোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর গতবার অল্প টাকায় দিতে মেয়র আনিসুল হক রাজি না হওয়ায় সর্বশেষ অনেক চাপের মুখে ১ কোটি ১ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। এবার দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। বাস্তবে এই হাট থেকে আদায় হয় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। ইজারাদার আবদুর রহমান রুবেল বলেন, হাটটি তার নামে নেওয়া হলেও এর সঙ্গে বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগসহ সবাই আছে। মিলেমিশে লাভের অংশ ভাগ করে নেন। তার দাবি, হাট থেকে অত টাকা লাভ হয় না। আর খুনের বিষয়টিও হাটকেন্দ্রিক নয়।
এ চিত্র কেবল আফতাবনগর হাটের নয়, আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীতে বসতে যাওয়া ২১টি পশুরহাটের প্রায় সবই দখলে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। একাধিক ইজারাদার বলেন, হাট ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম তিনটি দরপত্র জমা পড়তে হয়। সাধারণ ইজরাদাররা দরপত্রই কিনতে পারেননি। দু-একজন কিনলেও ভয়ে জমা দেননি বা দিতে পারেননি। ফলে প্রভাবশালী চক্র পছন্দমতো দর দিয়ে হাটগুলো ইজারা নিয়েছে। আবার কয়েকটি হাটের ক্ষেত্রে কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি। সেগুলো অতীতের মতো ঈদের আগমুহূর্তে দলীয় লোকদের দিয়ে পরিচালনা করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কয়েকটি স্থানে হাট বসানোর পরিকল্পনাই বাদ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সাধারণ ইজারাদাররা মনে করেন, এসব স্থানেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।
হাটগুলো কেবল দলীয় নেতা-কর্মীরাই কীভাবে পেল- এ প্রসঙ্গে ইজারার সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়। জমা পড়া দরপত্রের কাগজপত্র ঠিক থাকলে শীর্ষ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কে কোন দল করে, তা বিবেচ্য বিষয় না। অবশ্য বিগত বছরের চেয়ে কম দর হলে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। এবার নয়টি হাটের তিনটিতে কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি বলেও জানান তিনি।
ডিএনসিসির ইজারা দেওয়া নয়টি হাটের মধ্যে ইজারাদারদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত বলে জানা যায়। কয়েকজন পদধারী নেতাও আছেন। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর গোলচত্বর সংলগ্ন খালি জায়গার হাটটি ইজারা পেয়েছেন দক্ষিণখান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শফিক। স¤প্রতি ডিএনসিসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া দক্ষিণখানের একটি ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগ থেকে কাউন্সিলর নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ভাটারার হাট ইজারা পেয়েছেন ক-৮১ শাহজাদপুরের বাসিন্দা গুলশান থানা আওয়ামী লীগের নেতা মোজাফফর হোসেন। মোহাম্মদপুরের বসিলা পুলিশ লাইন্সের জায়গার হাট পেয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গার হাট পেয়েছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাহউদ্দিন মাহমুদ। মিরপুরের ডিওএইচএস সংলগ্ন উত্তর পাশের খালি জায়গা পেয়েছেন বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সাবেক এমপি এখলাস উদ্দিন মোল্লাহর ছেলে ইমরান উদ্দিন মোল্লাহ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) অধীন হাটগুলোরও প্রায় একই অবস্থা। খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া বাজার পশুরহাটের ইজারা পেয়েছেন ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ শরীফ। উত্তর শাজাহানপুরের খিলগাঁও রেলগেট সংলগ্ন মৈত্রীসংঘের মাঠ পেয়েছেন ১১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ। গোপীবাগের হাটটির ব্যপারে এখন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এই হাটটি ইজারা নেয়ার জন্য সহিদ উদ্দিন নামের আওয়ামী লীগের এক সমর্থক জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু জানান, সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নাসির ইতালি থেকে হাটটি নিয়ন্ত্রণ করেন। সে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কিছু নেতা-কর্মীর মাধ্যমে হাটটি পরিচালনা করে থাকেনন। এতে দু’পক্ষেরই লাভ। কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন খালি জায়গার হাটটিও এখনো ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। তবে এ হাটটিও নেয়ার জন্য জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন ওয়ারীর ২নং শহীদ নজরুল ইসলাম সড়কের মোহাম্মদ আমের খান। তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ জানান, তিনি যে আমের খানকে চেনেন, সে হলে আওয়ামী লীগেরই হবে। হাজারীবাগ হাটের ইজারা পেয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের নেতা অহিদুর রহমান ওয়াকিব।
তিনি রাজধানীর এক আওয়ামী লীগ দলীয় এমপির ঘনিষ্ঠ। রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ পেয়েছেন মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতা হাজি শফি মাহমুদ। কামরাঙ্গীরচর চেয়ারম্যান বাড়ির হাটিটি পেয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন সরকার। আরমানিটোলা খেলার মাঠের ইজারা না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে গতকাল বুধবার। পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পাশের হাটের ইজারা পেয়েছেন শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগ নেতা মইন উদ্দিন চিশতি। দনিয়া কলেজ মাঠ সংলগ্ন খালি জায়গার ইজারা পেয়েছেন আবুল কালাম আজাদ। শ্যামপুর বালুর মাঠ পেয়েছেন শেখ মাসুক রহমান। তারাও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত বলে জানা যায়। এ ছাড়া ধোলাইখালের সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ সংলগ্ন হাটির ব্যপারেও এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়টি। পুলিশ ও ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগের লোকজনদের হাত করে ৪২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা টেন্ডার ছাড়াই শেষ মুহূর্তে হাটটি বসিয়ে দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অনেকেই হাট নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেন না। আসলে যারা কম দর দিয়ে হাট পান না, তারাই এসব কথা বলে। দরপত্র কিনতে বাধা, জমা দিতে না দেওয়া- এসব অনিয়মের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। নিয়ম মেনে যদি সব হাট আওয়ামী লীগের লোক পেয়ে যায়, তাহলেও কিছু করার নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন