রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার বাহিনীর বর্বরতা

| প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রোহিঙ্গাদের আর্তনাদে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে। ওপারে মিয়ানমার বাহিনীর নির্মূল অভিযান এ পারে বিজিবি’র সতর্ক প্রহরা ও পুশব্যাক কার্যক্রমে নাফ নদীতে ভাসমান শত শত মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বার্মিজ সীমান্ত পুলিশের পলায়নপর রোহিঙ্গাদের উপর গুলি চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিক গুলিবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ ও আহত অবস্থায় কক্সবাজারে ঢুকেছে বলে জানা যায়। এদের কেউ কেউ কক্সবাজার ও চট্ট্রগামের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে রাখাইনের মুসলমানদের উপর যে সামরিক নির্যাতন ও উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাখাইনে একটি প্রতিরোধ সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। গত বছর সীমান্ত চৌকিতে বন্দুক হামলার পর রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব আহ্বান উপেক্ষা করে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। সেনা অভিযান বন্ধের লোক দেখানো ঘোষণা প্রচার করা হলেও স্থানীয় বৌদ্ধদের সহিংসতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রোহিঙ্গাদের উপর এথনিক ক্লিনজিং এর তদন্ত ও মধ্যস্থতাকারি কমিটিও মিয়ানমারের সরকার এবং বৌদ্ধদের অসহযোগিতা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে।
রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনমত গড়ে উঠলেও এখন পর্যন্ত কোন প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছেনা। এমনকি রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের তদন্ত করতে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত তদন্ত কমিটিকেও মিয়ানমারে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি মিয়ানমার সরকার। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সাবেক সামরিক সরকার এবং বর্তমান নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যাচ্ছেনা। বরং রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন, বোমা মেরে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার মত ঘটনা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কোন পূর্ব সর্তকতা ছাড়াই গতে কয়েক দিনে রাখাইন মুসলমানদের শত শত বাড়িঘরে অনেকেই নিজঘরে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। কেউ কেউ অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় মানবেতর উপায়ে জঙ্গল ও নদী পেরিয়ে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। নীতিগতভাবে বাংলাদেশ তার সীমান্তে বাড়তি সতর্কতা এবং রোহিঙ্গা প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করলেও সীমান্তের সাধারণ মানুষ অসহায় রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারছেনা। অনেকেই তাদেরকে মানবিক আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট ও ছবিতে রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর হত্যা নির্যাতনের ভয়ে লাখ লাখ মানুষের সীমান্ত পথে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় গ্রহণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শুধু মুসলমান ও নিকটতম প্রতিবেশী সম্প্রদায় হিসেবেই নয় মানবিক বিবেচনায়ও রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়ানো বাংলাদেশসহ মিয়ানমারের সব প্রতিবেশির দায়িত্ব। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্বসম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাংলাদেশেও এক ধরনের সামাজিক রাজনৈতিক মতৈক্য গড়ে উঠেছে।
বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে আরাকানের মুসলমানদের শত শত বছরের সাংস্কৃতিক ও ভ‚রাজনৈতিক ঐতিহ্য থাকা সত্বেও সম্প্রতি রোহিঙ্গাদেরকে ‘বাঙ্গালী সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করেছে মিয়ানমার সরকার। বাংলাদেশের তরফ থেকে তাদের এমন মনোভাবের প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি কথিত রোহিঙ্গা সশস্ত্র যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সীমান্তে যৌথ অভিযান পরিচালনারও প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে মিয়ানমারের লক্ষ্য যেন রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নয়, তারা এসব সন্ত্রাসী তৎপরতার অজুহাত খাড়া করে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে চায়। রাজনৈতিক পরিভাষায় যাকে এথনিক ক্লিনজিং নামে অভিহিত করা হয়। শত শত রোহিঙ্গা নাগরিক সামরিক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত, ধর্ষিত ও হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার তথ্য প্রমাণ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও মিয়ানমার সরকার তা যথারীতি অস্বীকার করছে। লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করেও অপরাধিদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবীর প্রেক্ষিতেও এসব অপরাধে কাউকে নিন্দা করা বা লঘু শাস্তিও দেয়নি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এ থেকেই বোঝা যায় রোহিঙ্গা দমনাভিযানের মাধ্যমে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বের করে দেয়া মিয়ানমার সরকারের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মাত্র তিনদিনে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করেছে মিয়ানমার বাহিনী। সভ্য দুনিয়ায় এমন নির্বিচার নৃসংশ বর্বরতা চলতে পারেনা। এই বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বসম্প্রদায়কে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। দক্ষিন এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত ও চীনকে ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি নিকটতম প্রতিবেশি ও ভুক্তভোগি হিসেবে রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশ সরকারকে আরো দঢ় ও দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন