খুলনা ব্যুরো : চলমান সদস্য সংগ্রহ অভিযানে তৃণমূলে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে বিএনপি। অল্প সময়েই খুলনাতে সদস্য সংগ্রহের টার্গেটে পৌঁছে গেছে দলটি। তবে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের মধ্যে পারস্পারিক দুরত্ব বাড়ছে। সংগঠন রয়েই গেছে আগোছালো। ফলে সুসজ্জিত ও শক্তিশালী প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আসন্ন খুলনা সিটি করপোরেশন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র ভরাডুবি আশঙ্কা করছেন নেতাকর্মীরা।
সূত্রমতে, ২০১৩ সালের ১৫ জুনে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৬১ হাজার ২০৭ ভোটের ব্যবধানে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ তালুকদার আব্দুল খালেককে পরাজিত করে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি মেয়র নির্বাচিত হন। তৎকালীন জাতীয় সেই ইস্যুগুলো এখন আলোচনায় নেই নগরবাসীর। নানা কারণে নগরবাসীর প্রত্যাশা পুরণ করতে পারেননি মেয়র। রাজনৈতিক দু’টি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ায় ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর মেয়র মনিরুজ্জামান মনিকে সাময়িক বরখাস্তের এক বছর ১৯দিন পর গেল বছরের ২১ নভেম্বর দায়িত্ব ফিরে পান। আগামী বছরের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য কেসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে চান তিনি। এরমধ্যেই আগাম প্রচার-প্রচারণায় নেমেছেন জেলা বিএনপি’র সভাপতি এ্যাড. শফিকুল আলম মনা ও নগর বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি শাহারুজ্জামান মোর্ত্তজা। সিটি মেয়র মনিরুজ্জামান মনি’র প্রতি প্রত্যাশা প্রাপ্তির বিশাল ফারাক থাকলেও; দলীয় শৃঙ্খলা পাশ কাটিয়ে অন্যদের আগাম প্রচারকে ভালভাবে দেখছেন নগর বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। জেলা বিএনপি’র সভাপতিকে নগরীর শীর্ষ জনপ্রতিনিধি হওয়ার প্রচারণা বাঁকা চোখে দেখছেন নগর শাখার শীর্ষ নেতারা। এতে নগর ও জেলা বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের মধ্যকার দুরুত্ব বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। আসন্ন কেসিসি নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি’র বিভক্তি এখন দৃশ্যমান। অবিলম্বে নগর বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নগর ও জেলা শাখার দুরত্ব নিরসন, অঙ্গ সংগঠনগুলো নির্বিমাণ করে ঐক্যবদ্ধ না হলে নিশ্চিত ভরাডুবির শঙ্কায় তৃণমূল নেতাকর্মীরা। অতীতে ঐক্যের রেকর্ড ভেঙে দীর্ঘদিন নগর ও জেলা বিএনপির পৃথক পৃথক কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। সাংগঠনিক বিষয় ছাড়াও মনোস্তাতিক দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়ছেন নগর ও জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতারা। নিজ নিজ অনুসারীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপি’র ভ্যানগার্ড খ্যাত অঙ্গ সংগঠনগুলোর নাজুক অবস্থা। সম্মেলন ছাড়াই কেন্দ্র থেকে প্রেসবিজ্ঞপ্তি মাধ্যমে প্রেরিত নগর ও জেলার যুবদল, ছাত্রদল দীর্ঘদিনেও পুর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি গত আট মাসে। ২০১০ সালের জুনে গঠিত নগর ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহŸায়ক কমিটি আজও অপূর্ণ। শ্রমিকদল, মহিলা দল, কৃষক দলসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলো অনেকটাই অদৃশ্যমান।
বিএনপি’র নতুন সদস্য ডাঃ সেখ আখতার উজ জামান বলেন, “ভোট ও ভাতের অধিকার আদায় এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেশের মানুষ বিএনপি’র দিকে তাকিয়ে আছে। এখন যদি সংগঠন গুছিয়ে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করা না যায়; তবে আগামী নির্বাচনগুলোতে ভরাডুবি হতে পারে। কারণ বিএনপি’র প্রধান প্রতিপক্ষ অত্যন্ত শক্ত ও শক্তিশালী।”
এসব বিষয়ে নগর বিএনপি’র সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, “খুলনা বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন দুরত্ব নেই। অনেক বড় দল; নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক। তবে নির্বাচনের লড়াইয়ে আমরা সবাই এক ও অভিন্ন। দল যাকে যেখানে মনোনয়ন দেবে; সবাই তার পক্ষেই কাজ করবো। সংগঠন গোছানো কাজ চলছে। ইতিমধ্যে সদস্য সংগ্রহ ও নবায়নে আমাদের টার্গেট পূরণ হয়েছে। অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে কিছু জায়গায় দুর্বলতা আছে, খুব শিগগরিই তা ঠিক করা হবে। ঈদের পরেই খুলনা বিএনপিকে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী রূপে দেখা যাবে। নির্বাচনের আগেই সব দ্বিধা-বিভক্তি নিরসণ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। একই সাথে কেসিসিতে বিএনপি মনোনীত মেয়র থাকাঅবস্থায় অন্যদের আগাম প্রচার-প্রচারণা সমুচিত নয় বলে মন্তব্য করলেন বিএনপি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু।
দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শুধু মাত্র খুলনা-১ আসনে (বটিয়াঘাটা-দাকোপ) বিএনপি’র একক প্রার্থী হিসাবে প্রচার-প্রচারণায় রয়েছেন দলটির জেলা সাধারণ সম্পাদক আমীর এজাজ খান। এ ছাড়া অন্য পাঁচটি আসনে বিশৃঙ্খলভাবে কয়েকজন করে প্রার্থী রয়েছেন। সেখানে চলছে অভ্যন্তরীণ লড়াই। একাধিক স্থানে বিএনপি’র প্রতিপক্ষ বিএনপি। আশঙ্কা রয়েছে রক্তক্ষীয় সংর্ঘষেরও।
খুলনা-২ (সদর-সোনাডাঙ্গা) দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসন এটি। এখান থেকেই খুলনা মহানগর, জেলার ও বিভাগীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়। খুলনার সাধারণ মানুষ ও দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে নগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুর রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তবে প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন নগর বিএনপি’র সাবেক আহŸায়ক আলহাজ্ব আলী আসগর লবীও।
বিএনপি’র প্রার্থীর আধিক্যতা খুলনা-৩ আসনে (দৌলতপুর-খালিশপুর-খানজাহান আলী)। দলীয় মনোনয়ন পেতে আশাবাদী বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী সেকেন্দার আলী ডালিম, নগর বিএনপি’র যুগ্ম-সম্পাদক অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ এসএম আরিফুর রহমান মিঠু। দলীয় টিকিট পেতে তৎপর সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ফখরুল আলমও। এ ছাড়া মনোনয়ন পেতে কেন্দ্রে লবিং চালাচ্ছেন সাবেক ছাত্রদল নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল। নগর বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দৌলতপুর-খালিশপুর ও খানজাহান আলী থানা এলাকায়। এ অঞ্চলে দলটি’র একটি অংশ নগর বিএনপি’র কোষাধ্যক্ষ এসএম আরিফুর রহমান মিঠুর নেতৃত্বে পৃথকভাবে দলীয় কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছে।
খুলনা-৪ আসনে (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী ছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ কামাল তাজ। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি খুলনা-৪ আসনে বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশী। এছাড়া সম্ভাব্যপ্রার্থীর মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন বিএনপি’র তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল। এ আসনের রূপসা উপজেলা বিএনপিতে কোন সভা-সম্মেলন ছাড়াই গত ১৬ আগস্ট প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন জেলার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। এর প্রতিবাদে গত ১৮ আগস্ট খুলনা প্রেসক্লাবে রূপসা উপজেলা বিএনপি’র সদ্য সাবেক সভাপতি শেখ আব্দুর রশিদ ও মোল্যা খায়রুল ইসলামসহ সহ¯্রাধিক নেতাকর্মী সংবাদ সম্মেলন করেন। গত ২২ আগস্ট সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে সম্মেলন ছাড়াই প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে করা কমিটি স্থগিতের আবেদন করেন তারা। সে অনুযায়ী গত ২৭ আগস্ট দশদিনের মধ্যে জেলা ও রূপসার শীর্ষ চার নেতাকে কারণদর্শানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রূপসা উপজেলা বিএনপিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে বলে নেতাকর্মীদের অভিযোগ।
খুলনা-৫ (ফুলতলা-ডুমুরিয়া) আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডাঃ গাজী আব্দুল হক। পরে প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দিন মিঠু। তিনি গত ২৫ মে রাতে নিজ বাসভবনের সামনে ব্যক্তিগত অফিসে দেহরক্ষীসহ আতঁতায়ীদের হাতে খুন হন। পরে দলের একটি অংশের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে পুলিশ। এতে ফুলতলা বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে পারস্পারিক অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। এদিকে, বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী তালিকায় রয়েছেন দলটি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. মামুন রহমান ও ডুমুরিয়া উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি খান আলী মুনসুর।
খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে এবার আর জামায়াতে ইসলামীকে ছাড় দিতে নারাজ বিএনপি। তাই আগেভাগেই প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি ও কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি এ্যাড. মোমরেজুল ইসলাম, জেলা শাখার সহ-সভাপতি মনিরুজ্জামান মন্টু ও পাইকগাছার আহŸায়ক ডাঃ আব্দুল মজিদ এবং ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম রফিক। কয়রাতে বিএনপি’র বড়ধরণের কোন্দল না থাকলেও পাইকগাছায় দলটির মধ্যে শাখা-প্রশাখা রয়েছে। কয়রা-পাইকগাছার ১৭টি ইউনিয়নেই বিএনপি’র শক্তঘাঁটি রয়েছে। তবে অনৈক্যের কারণে আগোছালো দলটি।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এ্যাড. মঞ্জুর আলম নান্নু বলেন, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে কয়রা-পাইকগাছার ১৭টি ইউনিয়নের ১৪-১৫টিতেই বিএনপি’র ইউপি চেয়ারম্যান ও সিংহভাগ মেম্বর নির্বাচিত হন। সে হিসেবে খুলনা-৬ আসনের দাবিদার আমরাই (বিএনপি)।”
জেলা বিএনপি’র সভাপতি এ্যাড. শফিকুল আলম মনা বলেন, “কোথাও কোথাও একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছেন; তবে জেলা বিএনপিতে কোন কোন্দল নেই। যেমন- দল চাইলে আমি কেসিসি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হবো। গত নির্বাচনেও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলাম; দল চাইনি, তাই প্রত্যাহার করে বর্তমান মেয়রের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হয়েছিলাম। নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচার-প্রচারণা, শুভেচ্ছা বিনিময় যে কেউ করতে পারেন। এতে দল আরও মজবুত হয়; দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি নয়। কেসিসি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল যাকেই মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই সকলেই কাজ করবেন, এমনি প্রত্যাশা তার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন