রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়ন চরম আকার ধারণ করেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, রাখাইন রাজ্যের বাথেটং শহরের আশপাশের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা এ ছবি প্রচার করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিন্দা জানিয়েছে। নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস মিয়ানমারে মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর হত্যা-নির্যাতন বন্ধ করার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মিয়ানমারকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, মুসলমান হত্যা ও বিতাড়ন বন্ধ না করলে তুরস্ক নিশ্চুপ বসে থাকবে না। এরদোগান রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদকে ফোন করে প্রশংসা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টও মিয়ানমারকে মুসলমান নিধন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে কড়া হুশিয়ারি দিয়েছেন। রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনার জন্য ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এলপি মারসুদি গতকাল মিয়ানমার গিয়েছেন। সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করবেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়েও দেশটির অবস্থান জানবেন তিনি। আজ তিনি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসবেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও হুশিয়ারি উপেক্ষা করেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমান হত্যা ও বিতাড়ন অব্যাহত রেখেছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়ন দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। গত বছর ৯ অক্টোবর মিয়ানমারে পুলিশ পোস্টে হামলার ঘটনার জের ধরে রোহিঙ্গাদের উপর দেশটির সেনাবাহিনী, পুলিশ ও উগ্র বৌদ্ধদের হামলা ও হত্যাযজ্ঞ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া এবং তাদের উপর হামলা বন্ধের আহ্বান জানায়। কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে রাখাইনে যেতে চাইলে কমিশনের সদস্যদের বাধা দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই কফি আনান কমিশন তার তদন্ত প্রতিবেদন গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমার সরকারের কাছে জমা দেয়। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া এবং মুক্তভাবে চলাফেরা করার সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদন জমা দেয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই কথিত রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি কিছু নিরাপত্তা চেকপোস্টে হামলা চালালে দেশটির সরকার রোহিঙ্গাদের উপর নির্বিচারে হত্যা ও নিধন অভিযান শুরু করে। রোহিঙ্গাদের উপর নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন, বাড়িঘর এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা স্থল ও নৌপথে আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নতুন করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া সম্ভব না হওয়ায় সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। তারপরও রোহিঙ্গারা যে যেভাবে পারছে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। কাঁটাতারের ওপারে এবং নো ম্যান্স ল্যান্ডে শত শত রোহিঙ্গা প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। নৌপথে পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতে এ পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক নারী ও শিশু নিহত হয়েছে। সীমান্তে কড়াকড়ি সত্তে¡ও ইতোমধ্যে প্রায় ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জানিয়েছে। এমনিতেই প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাস করছে। নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানালেও রোহিঙ্গা হত্যা এবং নিধন বন্ধে তারা মিয়ানমারের উপর কার্যকর কোনো চাপ প্রয়োগ করছে না। তাদের বক্তব্য ও বিবৃতি এখন লিপ সার্ভিসে পরিণত হয়েছে। অথচ তারা যদি মিয়ানমারের উপর সত্যিকার অর্থে চাপ প্রয়োগ করে, তবে মিয়ানমারের পক্ষে রোহিঙ্গা নির্মূলিকরণ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে সীমান্তে জঙ্গী ও উগ্রবাদ নির্মূলে যৌথ অভিযান পরিচালনার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। স্বপ্রণোদিত হয়ে এ ধরনের প্রস্তাব দূরদর্শিতার পরিচায়ক নয় বলে তারা মনে করছেন। এতে মিয়ানমার আরও আস্কারা পেয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লংঘন করেছে। এটি দেশটির ধৃষ্টতা ছাড়া কিছুই নয়।
এটা স্পষ্ট যে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের তার দেশে থাকতে দিতে চাচ্ছে না। দেশটির নেত্রী অং সান সূচির বক্তব্যেও তা প্রতীয়মাণ হয়। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, রোহিঙ্গারা বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশের নাগরিক। এ ঘোষণা দিয়েই তার সরকার রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন এবং নির্মূল করতে চাইছে। বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বাড়তি চাপ হয়ে উঠেছে। এ চাপ একা সামাল দেয়া অসম্ভব হলেও মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের যথাসাধ্য আশ্রয় দিচ্ছে। অথচ রোহিঙ্গারা ৮ম শতাব্দী থেকেই মিয়ানমারে বসবাস করছে এবং তারা দেশটির নাগরিক, এটি ঐতিহাসিক সত্য। এ সত্য আমলে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সমস্যার সামাধানে এগিয়ে আসা। সবার আগে প্রয়োজন রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের হত্যা ও নিয়ার্তন বন্ধে চাপ প্রয়োগ করা। কেবল বিবৃতি দিয়ে আহ্বান জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আমরা মনে করি, মিয়ানমারের সাথে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর যে সম্পর্ক রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা দরকার। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তারা সেখানেই রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা লাভের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে, এ বিষয়টি নিশ্চিতে উদ্যোগ নেয়া। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। তাদেরকে নিজ দেশেই পুনর্বাসন এবং সমান নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন