বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানীতে অশনি সংকেত

প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অনেক অপেক্ষার পালা শেষে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানীর বন্ধ দরোজা খোলার এক ঝিলিক সম্ভাবনা দেখা দেয়ার পর তা’ আবার হতাশার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। প্রায় ৮ বছর ধরে বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশী শ্রমিক পাঠানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও চেষ্টা-তদ্বির কম করা হয়নি। মালয়েশিয়া সরকারের শর্ত পূরণের মাধ্যমে স্বল্প খরচে জি টু জি প্রক্রিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগও চূড়ান্ত হয়েছিল তিন বছর আগে। তবে এই প্রক্রিয়াও নানা জটিলতায় আটকে যাওয়ায় প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর তা’ও বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতোশ্রী রিচার্ড রায়ত জায়েম এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি স্ব স্ব দেশের পক্ষে জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে আগামী ৫ বছরে ১৫ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যেতে পারবে বলে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই পূর্ব মালয়েশিয়ার কোতাকিনাবালু মোয়ারা তুয়াং আর্মি ক্যাম্পে সেনা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক শেষে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো শী ড. আহমেদ জাহিদ হামিদি জানান, বাংলাদেশসহ অন্যান্য সোর্স কান্ট্রি থেকে মালয়েশিয়া অভিবাসী কর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সাথে মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে শুরু থেকেই বিস্তর ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর ফিরে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় দাতো শ্রী রিচার্ড রায়ত জায়েম যে বক্তব্য দেন তার সাথে কথিত সমঝোতা চুক্তির কোন মিল ছিল না। গত একমাস ধরে এ নিয়ে এক ধরনের অস্বচ্ছতা বা ধোঁয়াশা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। অবশেষে গত শনিবার মালয়েশিয়ার মন্ত্রী সভা বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগে মন্দা বিরাজ করছে। সেইসাথে মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ট্রাডিশনাল বাজারগুলোও বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ করে দেয়ায় দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও এক ধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও এসব দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সমস্যা নিরসনে কিছু উদ্যোগ নিতে দেখা গেলেও আদতে তার কোন ফলাফল দেখা যায়নি। মালয়েশিয়ার সাথে সরকারীভাবে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ হিসেবে ২০১৩ সালে প্রথমে জি টু জি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কয়েক লাখ কৃষিশ্রমিক পাঠানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা’ ব্যর্থ হওয়ার পেছনে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের অপ্রতুল ও অকার্যকর উদ্যোগকেই দায়ী করেন বিশ্লেষকরা। অভিজ্ঞ বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্টদেরকে জি টু জি প্রক্রিয়ার বাইরে রাখার কারণে সে সময় মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর টার্গেট পূরণ বা বিদেশগামী শ্রমিকদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। সে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্টদের সম্পৃক্ত করে জি টু জি প্লাস ফর্মুলায় বছরে ৩ লাখ হারে ৫ বছরে ১৫ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় পাঠানোর যে সম্ভাবনা ও প্রত্যাশা দেখা দিয়েছিল, তা ছিল গত ৮ বছরের ব্যর্থতা ও হতাশা ভুলিয়ে দেয়ার মত। অবশেষে তা’ও যেন কোন অদৃশ্য কারণে ব্যর্থতা ও হতাশায় পর্যবসিত হলো।
আজকের দুনিয়ায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পক মূলত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। শতকরা বিরানব্বই শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর জনবহুল দেশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ শুরু থেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য ছিল। দশকের পর দশক ধরে এসব দেশে কর্মরত শ্রমিকরাই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রেমিটেন্স প্রবাহ এবং অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান এবং কর্মপরিবেশ না থাকায় লাখ লাখ শ্রমিকের পাঠানো ঘাম ঝরানো ডলারের সঠিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে না পারায় এসব ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হয়ে রিজার্ভে রেকর্ড করছে। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্টরা শ্রমজীবী মানুষের ঘাম ঝরানো সেই রিজার্ভ বা কোষাগারও রক্ষা করতে পারছে না। জালিয়াতি এবং অনলাইন হ্যাক করে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ দেশের মানুষের আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান, বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং বিদেশ থেকে পাঠানো ও সঞ্চিত অর্থ, কোনটাই রক্ষা করা যাচ্ছে না। মালয়েশিয়ায় শ্রমশক্তি রফতানীর ক্ষেত্রে আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যেমন ব্যর্থতা রয়েছে, একইভাবে মালয়েশিয়া সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরেরও অনীহা, গাফিলতি থাকতে পারে। মালয়েশিয়া বিভিন্ন সোর্স কান্ট্রি থেকে শ্রমিক নিয়োগ দিলেও বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগে তাদের অনীহার মূল কারণ বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে সরকারের সংশ্লিষ্টরা ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন না। বিএমইটি’র সূত্র অনুসারে যেখানে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় প্রায় পৌনে ৩ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছিল, সেখানে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ থাকা এবং সর্বশেষ দুই দফায় জি টু জি, জি টু জি প্লাস প্রক্রিয়ায় বছরে ৩ লাখ শ্রমিক নিয়োগের সমঝোতা ব্যর্থ বা টানাপোড়েন সৃষ্টির বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্বসহ বিশ্লেষণ করে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ বন্ধে এখনো সরকারীভাবে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত বা লিখিত বিবৃতি পাওয়া যায়নি বলে জানা যায়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার পর মালয়েশিয়া সরকারের এ ধরনের একতরফা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়। এ পরিস্থিতি উত্তরণে অবিলম্বে সরকারকে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন