রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সুচির পাশে মোদি

| প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলছে নির্বিচার গণহত্যা। সে দেশের সেনাবাহিনী, বিজিপি, পুলিশ ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা একজোট হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঢালাওভাবে হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর-গ্রাম-মহল্লা পুড়িয়ে দিচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে এবং বাংলাদেশের দিকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ভীত-সন্ত্রস্ত ও পলায়নপর রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষদের ওপর গুলি চালাতে পর্যন্ত তারা দ্বিধা করছে না। রোহিঙ্গারা যাতে ফিরতে না পারে সে জন্য স্থল মাইন পোতা হয়েছে সীমান্তজুড়ে। নৌকায় গুলি বর্ষণ, নৌকাডুবি এবং স্থল মাইন বিষ্ফোরণেও রোহিঙ্গাদের মৃত্যু ঘটছে। একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল ও উৎখাতের লক্ষ্য নিয়ে যত রকমের নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা ও নৃশংসতা আছে তার সবই একযোগে প্রয়োগ করছে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা। ইতোমধ্যে গণহত্যার নির্মম শিকার হয়েছে কয়েকশত রোহিঙ্গা, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই অধিক। আর বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এবং হাজার হাজার বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় নো ম্যান্স ল্যান্ডে মানবেতর দুর্ভোগ মোকাবেলা করছে। এমন কঠিন বাস্তবতায় এবং সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে বিশ্ব বিবেক যখন নড়েচড়ে উঠতে শুরু করেছে ঠিক সেই মুর্হুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরে গেছেন। তার এ সফর নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ভারতীয় বিশ্লেষকই দাবি করেছেন, মুসলিম প্রশ্নে মিয়ানমারের ক্ষমতাশীনদের নীতি-অবস্থান এবং ভারতের ক্ষমতাশীন বিজেপির নীতি-অবস্থান অভিন্ন। সেটা জানাতে ও মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নিধনে গৃহীত ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করতেই মোদির এই সফর। রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিয়ামারের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। একই সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কিরন রিজুজি এক বিবৃতিতে ঘোষণা দেন যে, ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠানো হবে।
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং দেশটির ঐক্য ও সংহতির সার্থে এর অবসান কামনা করেছেন। তিনি চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে কিছু বলেননি। অং সান সুচি বৈঠকের পর জানিয়েছেন, সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতীয় মনোভাবের জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। তিনি এ আশাও প্রকাশ করেছেন যে, দুই দেশ একযোগে এই সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করতে পারবে। সুচির এ বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, মুসলমানদের বিষয়ে মিয়ানমার-ভারত বা সুচি-মোদির মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরৎ পাঠানোর বিষয়ে সুচি-মোদির আলোচনা হয়েছে। তবে কি সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা জানা যায়নি। সম্ভবত রাখাইন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটলে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার জোর চেষ্টা চালিয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচার করছে, রোহিঙ্গারা বাঙালি, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করেছে। বাস্তবতা ও ইতিহাস এই দাবি সমর্থন করে না। জাতিসংঘের বর্ণনায়, বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা রাষ্ট্রহীন নাগরিক, এ কথা সকলেরই জানা। তাদের কোনো নাগরিক, মানবিক এমনকি ইচ্ছামতো চলাফেরার অধিকারও নেই। তারা দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী। তাদের পক্ষে সন্ত্রাসবাদী হয়ে ওঠার কোনো সুযোগই নেই। তারপরও তাদের মধ্য থেকে ক্ষুব্ধ-হতাশ কিছু লোক যদি সন্ত্রাস ও সহিংসতায় আকৃষ্ট হয় তবে তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করতে হবে। এ জন্য গোটা জনগোষ্ঠীকে দায়ী করে তাদের নির্মূল ও বিতাড়নের সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে না। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে রাখাইনে বসবাস করছে। তারা সেখানকার ভূমিপুত্র। কোনোভাবেই বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী নয়। ইতিহাসই তার প্রমাণ বহন করে।
সন্দেহ নেই, মিয়ানমারের নীতি-অবস্থান ও পদক্ষেপের প্রতি আগ বাড়িয়ে ভারতের সমর্থন মিয়ানমারকে উজ্জীবিত করবে, জাতিগত নির্মূল অভিযান আরো কঠোর করতে প্ররোচিত করবে। ভারত যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে আগ্রহী তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, রোহিঙ্গা দমন-পীড়ন উৎসাদনের জন্যই সে এই প্রশিক্ষণ দিতে চায়। এতদিন ভারতীয় মুসলমানদের দমন-পীড়নে কারো কোনো সমর্থন ছিল না। এই সুযোগে সে মিয়ানমারকে সহযোগী ও সমর্থক হিসেবে পাবে। এতে ভারতে মুসলিম দমন-পীড়ন আরও বেড়ে যেতে পারে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতে মুসলমানরা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়ে গেছে। গো-রক্ষার নামে সেখানে যেভাবে নিরিহ মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে তাকে চরম বর্বরতা বললেও কম বলা হয়। ভারতের বিজেপি সরকারের মুসলিম বিদ্বেষ ও মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের মুসলিম বিদ্বেষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিদ্বেষের এই অভিন্নতাই তাদের সখ্যসূত্রে আবদ্ধ করেছে। মোদির সফরের এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন। দুই দেশের এহেন সখ্য এই অঞ্চলে মুসলমানদের জন্য, বিশেষ করে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এখন অন্তত ৯-১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। রোহিঙ্গা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান না হলে তাদের সংখ্যা আরও বাড়বে, যার ভার বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া মানবিক কারণেই জাতিগত নিধন অভিযান সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। প্রতিবেশীসহ মুসলিম দেশগুলোকে এ সমস্যার সমাধানে সক্রিয় করে তুলতে হবে। রোহিঙ্গাদের স্বার্থে ও বাংলাদেশের স্বার্থে এটা করা অত্যন্ত জরুরি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
motiar ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৬:৫১ এএম says : 0
inqilab potrikar maddhome sothik khobor paoya Jay........ ami inqilab potrikar Unnoti kamona kori
Total Reply(0)
আসিফ ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:২৯ পিএম says : 0
মানবিক কারণেই জাতিগত নিধন অভিযান সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
Total Reply(0)
selina ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৮:৪৬ পিএম says : 0
Muslim. Killing of guzrat of India was the then time same way occurred.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন