আমাদের দেশে-ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের নানা পণ্যে ছেয়ে গেছে। শিশুর গুড়ো দুধ থেকে বৃদ্ধের ইনসুলিন, রুপচর্চার কসমেটিক থেকে শক্তি বর্ধক ভিটামিন, এমন কি বেঁচে থাকার জন্য যা অপরিহার্য, সেই পানি এবং জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পর্যন্ত এখন ভেজালে ভরপুর। মাছ, দুধ, শাক সবজি ও ফলমূলে ফরমালিন, হলুদে সিসা, মরিচে ইটের গুঁড়া, সরষের তেলে কেমিক্যাল, মশার কয়েলে বিপদজনক উপাদান, গরুর গোশতে হরমোন, মুরগির খাবারে বিষাক্ত উপকরণ। টোকাই থেকে ধনীর সন্তান, ভেজালের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ নয় কেউ-‘যেন ভেজালেই জন্ম, ভেজালেই বেড়ে ওঠা, ভেজালের রাজ্যেই বসবাস । মানুষের মৌলিক চাহিদার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবন ধারণের জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এ বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবার প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলেছে বিবেকহীন ব্যবসায়ী ও আড়তদার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
ভেজাল খাদ্য পণ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে ১৯৯৪ সালে আমেরিকান এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির প্রতিবেদনে প্রকাশ, ফরমালিন ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গলবিল এলাকায় ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য ফরমালিনকে দায়ী করে।
টেক্সটাইল কালারগুলো খাদ্য ও পানীয়ের সঙ্গে মিশে শরীরে প্রবেশের পর এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যার ক্ষতি করে না। তবে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ক্ষতিগুলো হয় আমাদের লিভার, কিডনি, হৃৎপিন্ড ও অস্থিমজজ্জার। ধীরে ধীরে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বাচ্চা ও বৃদ্ধদের বেলায় নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি, তরুণদের কিছুটা দেরিতে। খাদ্যপণ্য ভেজালের কারণেই দেশে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি এগুলো অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রোগীদের লম্বা লাইন। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের ‘বিষাক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি’ শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ। কেমিক্যাল মিশ্রিত বা ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে যে উপসর্গগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো-পেটব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথাঘোরা, মল পাতলা বা হজম বিঘিœত মল, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া এবং দুর্বল হয়ে যাওয়া , পালস্ রেট কমে বা বেড়ে যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাজমেরী এস এ ইসলাম বলেন, ইউরিয়া ও হাইড্রোজ হচ্ছে এক ধরনের ক্ষার। এগুলো পেটে গেলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেপটিন এসিড তৈরি করে যা ক্ষুদামন্দা, খাবারে অরুচি, বৃহদাস্ত ও ক্ষুদ্রান্তে প্রদাহসহ নানা রকম শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে। জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের ডা. আহমদ সাইফুল জব্বার বলেন, মেটাল বেইজড ভেজাল খাবারে কিডনি স্বল্পমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ বিকল হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রে ভেজাল খাবারের জন্য হজমের গন্ডগোল, ডায়ারিয়া এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের এনেসথেশিয়া ডা. মোঃ মিল্লাত-ই-ইব্রাহীম বলেন, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে এ খাবারগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে। যা রান্না করার পরও অটুট থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় করে ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাসট্রিয়াল রঙ, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভেজাল খাবারের কারণে যে রোগগুলো দ্বারা মানুষ বেশি আক্রান্ত হয় তাহলো অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্য বিষক্রিয়া, অরুচি উচ্চরক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনি ফেলিউর, হার্ট অ্যাটাক প্রভৃতি। তাই খাদ্যে ভেজাল ও বিষাক্ত উপাদান দেয়ার প্রবণতা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এজন্য শুধু আইন থাকলে হবে না। সে আইন সংশ্লিষ্ট সবার বেলায় অবিলম্বে প্রয়োগ করা চাই, যাতে দোষীরা দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি পায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোকে দায়িত্ব সচেতন হতে হবে এবং ভেজাল বিরোধী কার্যক্রম সব সময় চালু থাকা জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কর্তব্যে অবহেলা এবং উৎকোচ ও উপঢৌকন গ্রহণসহ সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি। সেই সাথে নিরাপদ খাদ্যের দাবিতে গড়ে তুলতে হবে দেশব্যাপী জোরালো সামাজিক আন্দোলন।
ষ ডা: মাও: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিষ্ট, ০১৭১৬২৭০১৭০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন