শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধে মানববন্ধন, গণজমায়েত এমনকি মিয়ানমারের দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচিও পালিত হয়েছে এবং হচ্ছে। রোহিঙ্গা হত্যার শুরু থেকেই বাংলাদেশের মানুষ এর প্রতিবাদে সোচ্চার রয়েছে। গত শুক্রবার বিভিন্ন ইসলামী দল মিছিল ও সমাবেশ করেছে। আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার দূতাবাস ঘেরাওয়েরও কর্মসূচি দিয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে সাধারণ মানুষের পক্ষে এর বেশি আর কী করার থাকতে পারে! দেখা যাচ্ছে, তাদের এসব প্রতিবাদ মিয়ানমার সরকার থোড়াই কেয়ার করছে। সে তার মতো করে গণহত্যা এবং রোহিঙ্গা বিতাড়ণ অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ব্যক্তি পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা ডেসমন্ড টুটু, নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত ড. ইউনুস, মালালা ইউসুফজাই রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধে মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের পরিসংখ্যান দিচ্ছে। এ পর্যন্ত ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশকে ৫৭ কোটি টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দলকে মিয়ানমারে যাওয়ার অনুমতি এবং আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। ইইউ বলেছে, রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর সংযত আচরণ ও নিরস্ত্র নাগরিকদের রক্ষায় দায়িত্ব রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাগুলো থেকে রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে কেবল আহ্বান জানানো হচ্ছে, মিয়ানমারকে গণহত্যা ও বিতাঢ়ণ বন্ধে বাধ্য করা হচ্ছে না। অথচ সবার আগে প্রয়োজন গণহত্যা ও বিতারণ বন্ধ করা।
এটা এখন স্পষ্ট, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের হত্যা ও নির্যাতন করে ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। রোহিঙ্গারা বাঙালি সন্ত্রাসী এবং তারা বাংলাদেশের নাগরিক এই ধারণার বাস্তবায়ন করছে। এতে মিয়ানমার সরকারের বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা সংশয় নেই। সে তার পরিকল্পনা মতোই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে ঝেটিয়ে বের করে দেয়ার জন্য বর্বরতম পন্থা অবলম্বন করে চলেছে। প্রতিদিনই হাজার হাজার অসহায়-নিঃস্ব রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অভিমুখে ছুটে আসছে। নদী পথে আসতে গিয়ে অনেকের সলিল সমাধি হয়েছে। লাশের পর লাশ বাংলাদেশের উপকূলে ভেসে আসছে। স্থলপথে আগত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। তারা কোনো না কোনোভাবে ঢুকে পড়ছে। মিয়ানমারে যেমন রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হচ্ছে, তেমনি কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেও মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার আগত রোহিঙ্গাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে। বলা বাহুল্য, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য একটি অনাহূত সমস্যা। বাংলাদেশের এ সমস্যায় পড়ার কোনো কারণ নেই। বলা যায়, বাংলাদেশ এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত ছিল না। তারপরও মানবিক কারণে অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে। কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে যে মানবিকতা বাংলাদেশ দেখাচ্ছে, বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো থেকে তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। তারা কেবল বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অবশ্য ইতোমধ্যে তুরষ্কের ফার্স্ট লেডি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন। তুরষ্কের ফার্স্ট লেডি রোহিঙ্গাদের দেখতে ছুটে যান। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান মিয়ানমারের উদ্দেশে কড়া হুশিয়ারি দিয়েছেন এবং রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকও রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছে মালদ্বীপ। দেশটি মিয়ানমারের সাথে তার সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার সরকার কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘের বিশেষ দূত জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা যে আরও অধিক হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এ হত্যাকান্ডকে সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তারা বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর না হলে দেশটিতে বসনিয়ার সেব্রেনিৎসার মতো আরেকটি মুসলমান গণহত্যাই ঘটবে।
রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নিধন বন্ধে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। মৌখিকভাবে হুশিয়ারি ও মন্তব্যকে যে মিয়ানমার আমলে নিচ্ছে না, তা রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে। পৃথিবীর বুক থেকে একটি জাতিকে এভাবে নির্মূল করে দেয়ার মতো ঘৃণ্যতম কাজ কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যায় না। আমরা মনে করি, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে কাল বিলম্ব না করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। এজন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তাই নিতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নিরস্ত্র ও নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার যে নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে তা বন্ধ করা না গেলে বিশ্বের কোনো দেশেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিরাপদ বোধ করবে না। এটি একটি খারাপ নজির হয়ে থাকবে। আমরা আশা করব, বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো মিয়ানমারে যে রোহিঙ্গা নির্মূলীকরণ অভিযান চলছে, তার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন