রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পূর্ব-উত্তরের জেলাগুলোতে ফের বন্যার আশঙ্কা

| প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ভারতের মেঘালয়, আসাম ও অরুণাচলে প্রবল বর্ষণের কারণে বাংলাদেশের পূর্ব-উত্তরের জেলাগুলোতে ফের বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মেঘালয় থেকে নেমে আসা পানিতে শেরপুর, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ডুবে গেছে এর মধ্যেই। শেরপুরের ভুগাই, নেত্রকোনার সোমেশ্বরী এবং সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওদিকে আসাম ও অরুণাঞ্চলের পানি নেমে আসায় ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও তিস্তায় পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। পদ্মা-সুরমার পানিবৃদ্ধির প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উজানে আরো বৃষ্টি হলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট এলাকা ও জেলাগুলোতে নতুন করে বন্যা বিস্তার লাভ করতে পারে। আগস্টে লাগাতার ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পানিতে বাংলাদেশের পূর্ব-উত্তর এবং মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলো ভয়ংকর বন্যার শিকার হয়। বাড়িঘর, জমিজিরাত, ফসলের খেত পানির নীচে চলে যায়। অন্তত ৮০ লাখ মানুষ এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬ লাখ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়। দেড় লাখ মৎস্যখামার ভেসে যায়। কম পক্ষে দেড়শ মানুষ বন্যা ও বন্যা সংশ্লিষ্ট কারণে মারা যায়। এরও আগে বন্যা আঘাত হানে হাওর অঞ্চলে। সেই বন্যারও মূল কারণ ছিল ভারত থেকে নেমে আসা পানি। বন্যায় হাওর অঞ্চলের ফসলের ৯০ শতাংশই বিনষ্ট হয়। এতে অন্তত ১০ লাখ টনের উৎপাদন ক্ষতি হয়। উপযুপরি বন্যায় এবার মানবিক, অর্থনৈতিক ও উৎপাদনক্ষতি যা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেমন ক্ষতি হতে দেখা যায়নি। বন্যার জের এখনো চলছে। এর মধ্যেই গৃহপুনর্বাসন, কৃষিপুনর্বাসন এবং পরবর্তী ফসল উৎপাদনের কাজও চলছে। এমতাবস্থায়, নতুন করে বন্যা দেখা দিলে তা হবে মড়ার ওপর খাড়ার ঘার শামিল।
বন্যা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই বন্যায় দেশের কোনো কোনো এলাকা আক্রান্ত হয়। মানবিক দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। বাড়িঘর-ফসলাদি নষ্ট হয়। নদীভাঙনের তান্ডবে বসতবাড়ি, জমি, স্থাপনা ধ্বংস হয়। বন্যা ও নদীভাঙন বহু মানুষ উদ্বাস্তু ও নি:স্ব হয়ে পড়ে। বন্যা ও বন্যাজনিত বিপর্যয় রোধে গৃহীত ব্যবস্থাবলী অনেক সময়ই কোনো কাজে আসে না। এবারও দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ, শহররক্ষা বাঁধ তেমন কোনো কাজে আসেনি। অথচ বন্যানিয়ন্ত্রণ ও জনপদ ও ফসল রক্ষার জন্য প্রতি বছর মোটা অংকের অর্থ বরাদ্দ করা হয়ে থাকে। বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হতে পারতো। কিন্তু এ অর্থের বড় অংশই অপচয় বা লুটপাট হয়ে যায়। ভৌগোলিক ও অবস্থানগত কারণে বন্যা সম্পূর্ণ নিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে বন্যানিয়ন্ত্রণ এবং জনপদ ও ফসল রক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হলে মানবিক বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো মোটেই অসম্ভব নয়। বন্যার কারণেগুলো মোটামুটি আমাদের সবারই জানা। নদীগুলো দীর্ঘদিন সংস্কারহীন অবস্থায় রয়েছে। এর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় নদীর পানি দু’কূল উপচে বন্যার সৃষ্টি করে। সংস্কার ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর পানিধারণ ক্ষমতা বাড়াতে পারলে বন্যা কখনোই এত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারতো না। নদীসংস্কার ও ড্রেজিংয়ের জন্য প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দ থাকলেও কাজের কাজ হয় না। আর একথা তো বলাই বাহুল্য, উজান থেকে ধেয়ে আসা বা ঠেলে দেয়া পানিই বন্যার সবচেয়ে বড় কারণ। অভিন্ন নদীগুলোতে ভারত বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করেছে শুকনো মওসুমে পানি প্রত্যাহার করার জন্য। সে কাজ ভারত ভালোভাবেই করছে। বাংলাদেশের নদীগুলোর মরণদশার জন্য উজানে দেয়া ওইসব বাঁধ ও প্রতিবন্ধকই প্রধানত দায়ী। দেখা যায়, বর্ষা মওসুমে যখন উজানে প্রবল বর্ষণ হয়, বন্যা দেখা দেয় তখন ভারত একযোগে অভিন্ন নদীগুলোতে দেয়া বাঁধের গেট খুলে দেয়। আর সেই বাঁধখোলা পানি বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেয়। এবারও সেটা লক্ষ্য করা গেছে। নদী নিয়ে, নদীর পানি নিয়ে ভারতের এই খেলা বন্ধ না হলে বন্যার তান্ডব ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন।
এবারের বন্যায় যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা মোকাবিলা করা বা পুষিয়ে নেয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে ফসলহানির প্রতিক্রিয়ায় চালের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। চাল আমদানি করেও দাম কমানো যাচ্ছে না। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, সরকারের এই দাবি ও প্রচরণার কোনো প্রমাণ মেলেনি। বরং দেখা গেছে, সরকারী খাদ্যগুদামে নূন্যতম মজুদও নেই। চালের দাম হু হু করে বেড়ে অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করলেও সরকার কিছু করতে পারেনি। বন্যার কারণে শুধু চালের দামই নয়, অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বাইরে চলে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষসহ প্রান্তিকজন ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য খাদ্য সহযোগিতা জরুরি হলেও সরকার সেই সহযোগিতা দিতে পারছে না। এটা একটা রূঢ় বাস্তবতা এবং এই বাস্তবতায় মানুষ বিচলিত ও উদ্বিগ্ন। গৃহ ও কৃষি পুর্নবাসনের কাজও অত্যন্ত শ্লথ। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ যদি মাথা গোঁজার ঠাঁই করে উঠতে না পারে, পরবর্তী ফসলের জন্য বীজ, সার, সেচ, ধান ইত্যাদিতে সুবিধা ও সহযোগিতা না পায় তবে আগামী ফসল উৎপাদনে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। এদিকে সরকারকে সর্বোচ্চ দৃষ্টি দিতে হবে। নতুন করে বন্যার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে সেদিকেও সতর্ক নজর রাখতে হবে। দ্রুতই বন্যাক্রান্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। অত:পর তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন