মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের তুমব্রু পয়েন্টের নো ম্যান্স ল্যান্ডে গত শনিবার রাতে ও রবিবার সকালে স্থল মাইন বিস্ফোরণে তিনজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়েছে। আহতদের একজন বাংলাদেশী বলে জানা গেছে। এই প্রথম নয়, এর আগেও স্থল মাইন বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর গণহত্যা ও গণনির্যাতনের পটভূমিতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে কিংবা পুনরায় রাখাইনে ফিরতে না পারে-তার আগেই যাতে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত হয়, সে জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সীমান্ত জুড়ে বিপুল সংখ্যায় স্থল মাইন স্থাপন করেছে। মিয়ানমারের সেনা ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, স্থল মাইন ব্যবহার করে নিরিহ বেসামরিক নাগরিক হত্যা তার অন্যতম প্রমাণ। মিয়ানমারের শীর্ষ নেত্রী অংসান সুচি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্থল মাইন পোঁতার খবর অস্বীকার করলেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তথ্য-প্রমাণসহ দেখিয়ে দিয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ এই মারণাস্ত্রটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ব্যবহার করছে। এ যাবৎ স্থল মাইন বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা থেকেও এর সাক্ষ্য মেলে। বিজিবি’র পক্ষ থেকে স্থল মাইন পোঁতার কথা জানানো হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে,’ ৯০ দশকের আগে-পরে তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে মিয়ানমার সীমান্তের ৭০-৮০ কিলোমিটার জুড়ে শত শত স্থল মাইন স্থাপন করে। তখন স্থল মাইন বিস্ফোরণ অর্ধ শতাধিক বাংলাদেশী কাঠুরিয়া নিহত হয়। আহত হয় দু’শতাধিক। এ নিয়ে তখন প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার কিছু স্থল মাইন তুলে নিতে বাধ্য হয়। ধারণা করা হয়, উত্তর কোরিয়া ও সিরিয়াসহ অল্প কিছু দেশের কাছে স্থল মাইন আছে। এদের মধ্যে মিয়ানমারও রয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত স্থল মাইন পুঁতে মিয়ানমার রাখাইনের হাজার হাজার পলায়নপর মানুষের জীবনকে ঝুঁকির ফেলে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের সীমান্ত-নাগরিকদের জীবনও এর ফলে ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। নো ম্যান্স ল্যান্ডে পাতা মাইনে বাংলাদেশী নাগরিক আহত
হওয়ার ঘটনা থেকে এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়।
স্থল মাইন একটি মারাত্মক মরণাস্ত্র। সাধারণত যুদ্ধের সময় শত্রুবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য মাইনের ব্যবহার হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা এই মাইন বিস্ফোরণে হতাহতের ৮০ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক। এ কারণে এর উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে সোচ্চার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ১৯৯৭ সালে মাইন ব্যান ট্রিটি হয়েছে, যা ১৯৯৯ সালে কার্যকর হয়েছে। ট্রিটি মতে, এই মাইন উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, ব্যবহার সবই নিষিদ্ধ। অথচ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তা অবলীলায় ব্যবহার করছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারে ডেপুটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দম্ভ প্রকাশ প্রকাশ করে বলেছিলেন, অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ল্যান্ড মাইন ব্যবহার অব্যাহত রাখবে। তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ল্যান্ড মাইন ব্যবহার মিয়ানমার তার নীতি ও সিদ্ধান্ত হিসাবেই গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে বিশ্বজনমত এবং এ সংক্রান্ত ট্রিটির প্রতি তার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। মিয়ানমার তার রাখাইন রাজ্যকে রীতিমত দোজখে পরিণত করেছে। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূল করার এহেন উপায় বা পথ নেই যা সে অনুসরণ করছে না। নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। মাল-সামান লুণ্ঠন করছে। নারীদের ধর্ষণ করছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের যে বিবরণ ও চিত্র আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত-প্রচারিত হচ্ছে, তাকে লোমহর্ষক বললেও কম বলা হয়। বস্তুত, মিয়ানমারের সেনাসহ বিভিন্ন বাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা এখন তার মানুষ পদবাচ্য নেই। রীতিমত তারা দানবে পরিণত হয়েছে। এই দানবদের সম্পূর্ণ প্রতিহত করা বা রুখে দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
বিলম্বে হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা উদ্বেগ জানানোর পাশপাশি নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছে। অবিলম্বে হত্যা-নির্যাতন বন্ধের দাবি জানাচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের ওপর এতে একটা চাপ তৈরি হয়েছে বটে, তবে এখনো হত্যা- নির্যাতন বন্ধের কোনো আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এখনো সমানে রোহিঙ্গা হত্যা-নির্যাতন চলছে, এখনো দলে দলে তারা বাংলাদেশ প্রবেশ করছে। ইতোমধ্যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা একমত যে, প্রতিবাদ, নিন্দা বা আহ্বানের মধ্যে দিয়ে এ পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন হবে না। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত কার্যকরযোগ্য ও বাস্তবসঙ্গত পদক্ষেপ নিতে হবে। কূটনৈতিক উদ্যোগ-পদক্ষেপে কাজ না হলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এমন কি সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে চোখের সামনে নির্মূল করে দেয়া হবে, আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে, এটা হতে পারে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর স্থল মাইন ব্যবহারের বিষয়টি বিশেষভাবে আমলে নিতে হবে। ইতোমধ্যে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। মিয়ানমারকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাকে মাইন তুলে নিতে বাধ্য করতে হবে। সীমান্ত এলাকায় এর ফলে যে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, যতদ্রুত সম্ভব তার অবসান ঘটাতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন