তথ্য-প্রযুক্তির দুর্বল নিরাপত্তা অবকাঠামোগত কারণে বড় ধরনের সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সর্বক্ষেত্রে আমরা ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম জোরদার করলেও, এর যে নিরাপত্তা অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তির আপডেট করা প্রয়োজন, এ বিষয়টির দিকে খেয়াল করছি না। ফলে সর্বত্র ডিজিটালাইজেশনের পুরনো প্রযুক্তিই থেকে যাচ্ছে। এ সুযোগে প্রযুক্তির আপডেটের সাথে সার্বক্ষণিক যুক্ত থাকা হ্যাকারসহ অন্যান্য অসাধু চক্র সহজেই বাংলাদেশে সাইবার আক্রমণ চালাতে পারছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রযুক্তির আপডেট ও নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের সাইবার হামলা হতে পারে। আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে এ ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এর বাইরে মোবাইলভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়েও মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। সাইবার হামলা হলে পুরো তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রটি ল-ভ- হয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি একটি বেসরকারী ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থ চুরি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে সাইবার হামলার মাধ্যমে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে তথ্য-প্রযুক্তির এই দুর্বল নিরাপত্তার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গত কয়েক দিন ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, সাইবার হামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম সারিতে রয়েছে। হ্যাকারদের এক নম্বর টার্গেটে রয়েছে বাংলাদেশ। উন্নত প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হ্যাকাররা বাংলাদেশের দুর্বল সাইবার নিরাপত্তার সুযোগ নিয়ে যে কোনো সময় হামলা চালিয়ে অকল্পনীয় সব ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। এর প্রাথমিক নমুনা হিসেবে হ্যাকাররা নিরাপদ দূরত্বে থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাকিং করার প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার সহজেই প্রবেশ করিয়ে বিপুল অংকের অর্থ লোপাট করে নিয়েছে। অর্থ লেনদেনের পাসওয়ার্ড বা কোডসহ অন্যান্য তথ্য চুরি করে পৃথক অ্যাকাউন্টে টাকা সরিয়ে নিতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। বলাবাহুল্য, আইটি ও সাইবার সিকিউরিটির দুর্বলতার কারণেই এমন ঘটনা ঘটতে পেরেছে। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশও এ প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হয়েছে। সরকার সব ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর সাথে দেশের সাধারণ মানুষও শামিল হয়েছে। তবে প্রযুক্তি যুক্ত হলেও এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি খুব একটা আমলে নেয়া হচ্ছে না। নতুন ধারণা প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর পূর্বাপর সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধার কথা উপেক্ষা করা হচ্ছে। বৃক্ষ রোপণ করলেই হয় না, সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে এর চারপাশে বেড়া দেয়া থেকে শুরু করে নিয়মিত পরিচর্যা ও যতœ নিতে হয়। তা নাহলে বৃক্ষ কখনোই ভালভাবে বেড়ে উঠবে না, ফলও দেবে না। তথ্য-প্রযুক্তির বিষয়টিও অনেকটা এরকম। এর প্রতি সবসময় দৃষ্টি রাখতে হয়। কারণ বিশ্বে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হচ্ছে। আজ যে প্রযুক্তি নতুন ও আধুনিক মনে হচ্ছে, কয়েক দিন পরে নতুন ভার্সন যুক্ত হয়ে তাকে পুরনোর খাতায় ফেলে দিচ্ছে। আমরা যদি মোবাইলের বিষয়টি বিবেচনা করি তাহলে দেখব, প্রায় প্রতিদিনই আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে নতুন নতুন ভার্সনের মোবাইল বাজারে আসছে। মানুষও পুরনোটা বদলে নতুন ভার্সনের সাথে যুক্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অফিস ডিজিটালাইজেশন বা তথ্য প্রযুক্তির আওতায় আনা হলেও আমরা দেখছি, সেগুলোতে যে সময়ের প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে, এখনও তা বলবৎ রয়েছে। আপডেটের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া তথ্য-প্রযুক্তির স্রোতের সাথে তাল মেলানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এর ফলে আপডেট থাকা সাইবার অপরাধী চক্রের পক্ষে পুরনো ভার্সনের প্রযুক্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থা সহজেই ভেঙ্গে ফেলতে পারছে। বাংলাদেশে তথ্য-প্রযুক্তির বিস্তার ঘটলেও এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে অত্যন্ত দুর্বল, তা ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ থেকে শুরু করে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে আইটি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবলের তীব্র সংকট রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে অধিকাংশ ব্যাংকে আইটি বিভাগে দক্ষ জনবল নেই। অল্প সংখ্যক কর্মকর্তাকে স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে আইটি বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, অনেক জায়গায় উন্নত ডিভাইস বা বড় সক্ষমতার সার্ভার থাকলেও এর অপারেটিং ও সিকিউরিটি সফটওয়্যার দুর্বল। এগুলো পরিচালনা করার জন্য দক্ষ জনবল নেই। এ পরিস্থিতি হলে যতই উন্নত প্রযুক্তি যুক্ত করা হোক না কেন, তাতে কোনো লাভ হবে না। কারণ গাড়ি কিনলেই হয় না, তা নিজে চালাতে না জানলে বা দক্ষ ড্রাইভার না থাকলে গাড়ি কেনা অর্থহীন।
তথ্য-প্রযুক্তির আধুনিকায়নের যুগে আইটি ও সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের স্বার্থেই তা করতে হবে। সাইবার হামলা মোকাবেলায় যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তথ্য-প্রযুক্তিগত মজবুত নিরাপত্তা অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি নিতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত-সবক্ষেত্রেই আইটি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ খাতে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য দৃঢ় নৈতিকতা সম্বলিত সৎ ও আস্থাভাজন জনশক্তি বাছাই ছাড়াও আইটিতে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার কার্যক্রমের উপর জোর দিতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর যেসব যন্ত্রপাতি বা ডিভাইস ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর অপারেটিং সিস্টেমের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সার্ভার, কম্পিউটার, স্মার্টফোন ইত্যাদিতে সময়োপযোগী ও বিশ্বস্ত অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যারের মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য ফায়ারওয়াল ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। শুধু প্রতিষ্ঠানের নয়, ব্যক্তি পর্যায়েও ডিজিটাল ডিভাইস যেমন কম্পিউটার, স্মার্টফোন এসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য। কারণ ব্যক্তির কম্পিউটার বা স্মার্টফোন থেকেও তথ্য চুরি করে হ্যাকাররা কোনো প্রতিষ্ঠানে সফলভাবে আক্রমণ চালাতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে ব্যাপক প্রচার চালানোর পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মকে সচেতন করে গড়ে তুলতে পাঠ্যপুস্তকেও সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতামূলক অধ্যায় সংযোজন এবং এ ব্যাপারে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও নিযুক্ত শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা সুবিধাদি দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন