শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবণতা

| প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিগত ১৬ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট বা পরিশোধযোগ্য স্থিতির পরিমাণ নেতিবাচক দিকে ধাবিত হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত আর্থিক বছরে যেখানে ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট ৪৮০ মিলিয়ন ডলার ছিল, চলতি অর্থ বছরে (২০১৭-১৮) তা কমে ১৭৯ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, চলতি অর্থ বছরের শেষে সার্বিক ব্যালেন্স ২.৩৫ বিলিয়িন ডলারে পৌঁছবে, তারপরও কারেন্ট অ্যাকাউন্ট বা চলতি হিসাবে ২.৭২ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি থাকবে। ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, আমদানি বৃদ্ধি এবং রপ্তানি হ্রাস পাওয়া। এই দুই খাতে ব্যাপক ব্যবধান পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ বছর জুলাইয়ে আমদানি বেড়েছে শতকরা ৪৭ ভাগ, যা গত বছর এ সময়ে ছিল মাত্র ২.৯৯ ভাগ। অন্যদিকে জুলাইয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি পায় শতকরা ১৮.৫০ ভাগ। অর্থাৎ রপ্তানির তুলনায় আমদানির হার ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রপ্তানির চেয়ে আমদানির হার বেড়ে গেলে, তা দেশের অর্থনীতির নেতিবাচক দিক নির্দেশ করে। বর্তমানে ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট হ্রাস পেয়েছে আমদানির অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে। এ থেকে প্রতীয়মাণ হয়, দেশ অনেকটা আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। বিনিয়োগ খাতে অত্যন্ত নেতিবাচক পরিস্থিতি চলছে। অর্থনীতিকে উন্নত করতে যেভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি প্রয়োজন, তা নেই বললেই চলে। দেখা যাচ্ছে, আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রপ্তানির পরিবর্তে আমদানির হার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানিতে কোনো ভারসাম্য নেই। পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে, এ দুই খাতের মধ্যে কত ব্যাপক পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, খাদ্য, মূলধনী মেশিনারি, তুলার আমদানি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাসে চাল ও মূলধনী মেশিনারির আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৬১ ভাগ। গত বছর জুলাইয়ে যেখানে খাদ্য আমদানি করা হয়েছে মাত্র ০.৮ মিলিয়ন ডলারের, সেখানে এ বছর করা হয়েছে ১০১.৮ মিলিয়ন ডলারের। দুধ, এডিবল অয়েল, চিনির আমদানি বেড়েছে শতকরা ২৬ ভাগ থেকে ১১৪ ভাগ পর্যন্ত। অন্যদিকে জুলাইয়ে রপ্তানি সামান্য বৃদ্ধি পেলেও আমদানির সাথে এর পার্থক্য এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আমদানি ও রপ্তানির মধ্যকার এই বিপুল পার্থক্য থেকে বোঝা যায়, দেশের অর্থনীতি ভাল অবস্থায় নেই। সরকার বৈদেশিক মুদ্রার যে রেকর্ড রিজার্ভ নিয়ে গর্ববোধ করে, তাতেও টান ধরেছে। চলতি বছরের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ছিল ৩৩.৪১ বিলিয়ন ডলার, সেখানে সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ তা কমে হয়েছে ৩২.৭৩ বিলিয়ন ডলার। আমদানি-রপ্তানির মধ্যকার ভারসাম্যহীণতার কারণে টাকারও অবমূল্যায়ন হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে এক ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৭৮.৪ টাকা, এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৮০.৭ টাকা। অর্থাৎ সার্বিকভাবে অর্থনীতির গতিপ্রবাহ ঋণাত্মক দিকে ধাবিত। আমরা যদি প্রতিবেশি দেশগুলোর দিকে তাকাই তবে দেখব, তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে শুরু করে আমদানির চেয়ে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলা যায়, প্রতিবেশি দেশের তুলনায় অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এদিকে সরকারের খুব একটা মনোযোগ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বলা বাহুল্য, একটি দেশে আমদানি তখনই বৃদ্ধি পায়, যখন দেশটির উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস পায়। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে তা দেশের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। যে চাল উৎপাদনে আমরা বছরের পর বছর ধরে রেকর্ড করে আসছি এবং রপ্তানিও করেছি, সে চাল এখন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। চালের দাম দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মানুষের জীবনযাপনে টানাপড়েন চলছে। সরকারের তরফ থেকে যেভাবে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। রপ্তানি থেকে শুরু করে সার্বিক অর্থনীতিতে চরম মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে না পারলে, দেশে ভয়াবহ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট সর্বশেষ কমেছিল ২০০০-০১ অর্থবছরে। তখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। ১৬ বছর পর একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যখন আওয়ামী লীগ সরকারই ক্ষমতায়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের শেষের দিকে এসে অর্থনীতি মন্দার দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এটা সরকারের নেয়া অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও পদক্ষেপ নেয়ার দুর্বলতার প্রকাশ। দেশের সার্বিক অর্থনীতি গতিশীল করার ক্ষেত্রে এটি ব্যর্থতা হিসেবে পরিগণিত হওয়া স্বাভাবিক। দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকা সত্তে¡ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে না পারা দুঃখজনক। দেশ যে দ্রুত গতিতে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ছে, এদিকে সরকারের মনোযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে একজন সাধারণ মানুষও জানে, আমদানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি কখনোই শক্তিশালী করা যায় না। দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হলে বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করব, দেশের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের হ্রাস পাওয়ার যে প্রবণতা, তা যাতে আরও হ্রাস না পায়, সেদিকে সংশ্লিষ্টরা সতর্ক থাকবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন