শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সুচির শেষ সুযোগ

| প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা-নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দেশটির নেত্রী অং সান সুচির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতরেস। সুচির জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দেয়ার প্রাক্কালে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, সুচি এখনই পদক্ষেপ না নিলে সংকট ভয়াবহ রূপ নেবে। সহিংসতা বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার এটাই তার শেষ সুযোগ বলে মনে করেন জাতিসংঘের মহাসচিব। হত্যা-নির্যাতন বন্ধে এখনই প্রয়োজনীয় চাপ প্রয়োগ করতে হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেছেন, সুচি যদি জাতির উদ্দেশ্য দেয়া ভাষণে তার অবস্থান পরিবর্তন না করেন তাহলে এই সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং ভবিষ্যতে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকবেনা। গুতরেস স্পষ্ট করে এও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়া উচিৎ। এটা স্পষ্ট যে, মিয়ানমারে এখনো ‘সেনাবাহিনীই সবার ওপরে।’ কিন্তু সেখানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যা হয়েছে তার জন্য তারা চাপে থাকবে। পরিস্থিতিকে জটিল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার, রাখাইনে যা হচ্ছে তা মূলত সেনাবাহিনীর চাপেই হচ্ছে। তবে তার আশা, ‘দেশটির নেত্রী পরিস্থিতি (সহিংসতা) থামাতে সক্ষম হবেন। তার আরও অভিমত, সহিংসতা বন্ধে সেনাবাহিনীর ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। সেই চাপ তৈরি করতে পারে তারা, যে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর যোগাযোগ আছে। ইতোপূর্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর যা ঘটছে তা কার্যত জাতিগত নির্মূলণ। তাদের ওপর আক্রমন উদ্বেগজনক ও অগ্রহণযোগ্য। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যক্তিদের ফেরার অধিকার স্বীকার করে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতরেসের মতো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলও মনে করে, রাখাইনে নির্বিচার গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। মিয়ানমারে দীর্ঘদিন পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে যতই আত্মপ্রসাদ লাভ করা হোক না কেন, কার্যত এখনো সেখানে ‘সামরিক শাসনই’ চলছে। অতীতের সামরিক শাসকরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশহীন, নাগরিকত্বহীন ও সর্বপ্রকার মানবিক অধিকারহীন করেছে। রাখাইনকে রোহিঙ্গা মুক্ত করার এবং তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পরিকল্পনাও তাদের। গণতান্ত্রিক সরকারের আড়ালে সেই সামরিক শাসকদের পরিকল্পনাই বস্তুত বাস্তবায়ন করছে বর্তমান সেনাবাহিনী। বলা যায়, এখন রাখাইনে যে বর্বরতা ও নৃশংসতা হচ্ছে, তা অতীতের ধারাবাহিকতারই অংশ। এটা জানা বা বুঝার জন্য বিস্তর সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন নেই। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান মিং অং হেই তার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে গত শনিবার যে পোষ্ট দিয়েছেন, তাতেই স্পষ্ট। তিনি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপের পক্ষে মিয়ানমারের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চোকিতে হামলার ঘটনাকে ‘বাঙ্গালী উগ্রবাদী’দের সহিংসতা বলে উল্লেখ করেছেন। এবং শেষে আসল কথা বলেছেন এভাবে,‘তারা রোহিঙ্গা হিসাবে স্বীকৃতি চাইছে যারা কখনোই মিয়ানমারের স্বীকৃত নৃগোষ্ঠী নয়। বাঙালী একটি জাতীয় প্রসঙ্গ। এই সত্যটি প্রতিষ্ঠায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধানের ইতিহাসজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়; যদিও তাতে কোনো লাভ নেই। শুধুমাত্র এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট, রোহিঙ্গারা রাখাইনের ভূমিপুত্র। শত শত বছর ধরে তারা সেখানে বসবাস করছে। এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নির্মূল করার অধিকার কোনো সরকার বা সেনাবাহিনীর থাকতে পারে না।
যখন বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে, যখন বলা হচ্ছে, রাখাইনে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সবচেয়ে উদ্বেগজনক সমস্যা, তখন মিয়ানমার সরকার এসব প্রতিবাদ, উদ্বেগ ও রোহিঙ্গাদের চরম মানবিক বিপর্যয়কে বিন্দুমাত্র আমলে নিচ্ছে না। আগের মতই গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়ন অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা ছিল, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী সুচি এই গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়ন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন এবং রোহিঙ্গাদের জন্মগত, রাষ্ট্রগত ও মানবিক অধিকার স্বীকার ও সুরক্ষা করবেন। অথচ তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রায় নিরব রয়েছেন। দু’চার কথা যা বলেছেন তা রোহিঙ্গাদের বিপক্ষেই গেছে। রোহিঙ্গাবৈরি সেনাবাহিনীর পদক্ষেপকেই তিনি সমর্থন করেছেন। বিশ্বের শান্তি ও মানবাধিকারকামী মানুষ মনে করে, তিনি যেহেতু মিয়ানমারের শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী এবং বর্তমান সরকারেরও প্রধান ব্যক্তি, সুতরাং রোহিঙ্গাদের গণহারে হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন তিনিই থামাতে পারেন। বিশ্বের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিবৃতি দিয়ে তাকে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিবও কথিত সাক্ষাৎকারে তার ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন। হত্যা-সহিংসতা বন্ধে তার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকের ধারণা, সেনাপ্রধানের বক্তব্য সুচির ওপর চাপ সৃষ্টিরই একটা চেষ্টা। এখন সুচি সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সেনাবাহিনীর খপ্পরে পুরোপুরি পতিত হবেন কিনা, নাকি মানবাধিকারের পক্ষে, নির্যাতীত-নিপীড়িত মানবত্মার পক্ষে, বিশ্ব জনমতের পক্ষে দাঁড়িয়ে হত্যা-নির্যাতন বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন, সেটাই দেখার বিষয়। বলাই বাহুল্য, তিনি যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যথোচিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আঃকাদের ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ৯:২৪ এএম says : 0
সুচি কে সুযোগ দেওয়া না দওয়া কোন লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না । তার ব্যপারে চুরান্ত সিদ্বান্ত নেওয়া অতি জরুরি।আজ সারাবিশ্ব এব্যপারে একমত।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন