দেশের প্রায় ১০ হাজার ডাকঘর ক্রমশ নিস্ক্রিয় হয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে বলে গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়। ডাকবিভাগের সুবিস্তৃত অবকাঠামো ও জনবল খাতে সরকারকে বছরে ২০০ কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। আমাদের ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্ভবত: দেশের প্রাচীনতম যোগাযোগ ও প্রশাসনিক অবকাঠামো যা শত শত বছর ধরে সারাদেশে প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। ঊনবিংশ শতকে বৃটিশদের মাধ্যমে আধুনিক ডাকব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার পাঁচশ বছর আগে থেকেই এ উপমহাদেশে ডাক ব্যবস্থার প্রচলণ ঘটিয়েছিলেন সুলতান ও মুঘল শাসকরা। ১২০৬ সাল থেকে দিল্লীর প্রথম সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লী থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। বিশ্বখ্যাত প্রাচীন পরিব্রাজক ইবনে বতুতার বর্ননা অনুসারে চতুর্দশ শতকে সিন্ধু থেকে দিল্লী পর্যন্ত অত্যন্ত কম খরচে ডাক ব্যবস্থার তথ্য পাওয়া যায়। ইবনে বতুতা সে সময় ভারতে ঘোড়সওয়ার ও পায়ে হাঁটা এই দুই ধরনের ডাক ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। সে সময় ডাক বিভাগের কর্মকর্তারা আংশিকভাবে পুলিশের দায়িত্বও পালন করতেন বলে জানা যায়। তবে উপমহাদেশের ডাক ব্যবস্থার উন্নয়নে শের শাহকে পথিকৃত বিবেচনা করা হয়। তিনি সোনারগাঁ থেকে সিদ্ধু নদের তীর পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মান করে প্রতি ২ মাইল অন্তর ডাক চৌকি স্থাপন করেন। সারাদেশে ১৭০০ ডাকঘর এবং প্রায় চার হাজার কর্মচারী নিয়োগ দেন। ইংরেজরা মূলত মুঘলদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য অনুসরণেই এ দেশে ডাক বিভাগের সংস্কার ও আধুনিকায়ণ করেছিল।
ঐতিহ্যবাহী সরকারী ডাক বিভাগের নিস্ক্রিয়তার পেছনে কাজ করেছে মোবাইল ফোন ও তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা। ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফার, পার্সেল সার্ভিস আদান প্রদানের ক্ষেত্রে ডাক বিভাগেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও গ্রামীণ ডাকঘরগুলোকে সেভাবে বিন্যস্ত ও কাজে লাগানোর কোন উদ্যোগ না থাকায় ডাকবিভাগ অকার্যকর ও লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। দেশের কোটি কোটি মানুষের হাতে হাতে মোবাইলফোন, ইন্টারনেট, ই-মেইল ও তথ্যপ্রযুক্তির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ সহজসাধ্য হওয়ায় ডাক ব্যবস্থার গতানুগতিক প্রয়োজনীয়তা কমে আসলেও এর বিপরীতে বেসরকারী কুরিয়ার সার্ভিস এবং অনলাইনে কেনাকাটা ও হোম ডেলিভারি সার্ভিস ব্যাপক ও বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে। অথচ সরকারী উদ্যোগে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্যকেন্দ্র চালু হলেও স্থানীয় ডাকঘরগুলোর সাথে এর সমন্বয় সাধন করা গেলে ডাক বিভাগকে গতিশীল করা সম্ভব। বিশেষত: বেসরকারী কুরিয়ার সার্ভিসগুলো যেখানে বছরে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে সেখানে ডাক বিভাগের এত বিস্তৃত অবকাঠামোকে লাভজনক খাত হিসেবে কাজে লাগানো অসম্ভব নয়।
এখনো দেশের বিশাল জনগোষ্ঠি দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। মোবাইলফোন ইন্টারনেট দূরের কথা এরা দু’বেলা খাবার সংগ্রহ করতেই পারেনা। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কথা বিবেচনা করেই ডাকবিভাগসহ আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। যেখানে অতি দরিদ্র মানুষও বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে তথ্যপ্রযুক্তির কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবে। ডাক বিভাগে কর্মরত প্রায় চল্লিশ হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী থাকা সত্তে¡ও, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিস্তৃত হাজার হাজার ডাকঘরের অবকাঠামোগুলো এখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। এসব অবকাঠামোর সংস্কার ও আধুনিকায়নের পাশাপাশি ডাকবিভাগের জনবলকে তথ্যপ্রযুক্তি সহায়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য ডাক যোগাযোগ, তথ্য আদান প্রদান ও কুরিয়ার সার্ভিসকে আরো সহজলভ্য ও নিরাপদ করা যেতে পারে। এতে ডাক বিভাগ একটি জনপ্রিয় ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হতে পারে। দেশের কোন কুরিয়ার সার্ভিসের এতবড় নেটওয়ার্ক, স্থায়ী জনবল বা অবকাঠামো না থাকলেও তারা বছরে কোটি কোটি টাকা লাভ করছে। এ প্রেক্ষিতে শত শত কোটি টাকা লোকসানি ডাক বিভাগের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বাস্তব উদ্যোগ প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে চিঠিপত্রের আদান প্রদান কমে গেলেও ডাক বিভাগের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। মোবাইল ব্যাংকিং, মানিট্রান্সফার, অনলাইন কেনাকাটা ও সরকারী তথ্যযোগাযোগের ক্ষেত্রে ডাকবিভাগ ওয়্যার হাউজের কাজ করতে পারে। এ বিষয়ে সরকারকে সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন