শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সু চির অসত্য ভাষণ

| প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের রাজধানী পনইপিদোতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি সত্যের অপলাপ করেছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী যখন রাখাইনের মুসলমানদের উপর ইতিহাসের বর্বরতম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, তখন বিশ্ববাসি অং সান সু চির ভ‚মিকা নিয়ে সন্দিহান ও হতাশ হলেও তার পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আশা করা হচ্ছিল। রাখাইন রাজ্যে জাতিগত রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর প্রায় একমাস ধরে সেনাবাহিনীর নির্মূল অভিযানে সারাবিশ্বের উদ্বেগকে কোন পাত্তা দিচ্ছেনা মিয়ানমার সরকার। বিশেষত: শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত, ডি-ফ্যাক্টো নেতা ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির নিরবতা বা বিতর্কিত ভ‚মিকার বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর দমনাভিযান ও এথনিক ক্লিনজিংয়ের খড়গ দীর্ঘদিন ধরে অব্যহত থাকলেও মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রত্যাশা ছিল অং সান সু চির নেতৃত্বে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে মানবাধিকারের উন্নয়ন ঘটবে। ইতিমধ্যেই সে প্রত্যাশা দূরাশায় পরিনত হয়েছে। অংসান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন ও নৃশংসতার মাত্রা পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে বেড়েছে। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের অর্ধশতাধিক বছরের ইতিহাসে এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক রোহিঙ্গা রাখাইন ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সু চির ভাষণে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া বা তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়েও কোন বক্তব্য নেই।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব এবং মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে সামনে এনে বিশ্বসম্প্রদায় যখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মিলিত হচ্ছে। সেখানে পরিস্থিতির পূর্বাপর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ একটি গ্রহনযোগ্য সমাধানের সম্মিলিত উদ্যোগের প্রত্যাশা করা হলেও অং সান সু চি এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে যোগ না দিয়ে তার অবস্থানকে আরো বিতর্কিত করেছেন। গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণের আগেই জাতিসংঘের তরফ থেকে মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, এই ভাষণই হবে সংকট নিরসন ও নিজের অবস্থান পরিস্কার করতে সু চি র জন্য শেষ সুযোগ। তবে সু চি যে উটপাখির মত বালিতে মাথা গুঁজে আছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তা বলে দিয়েছে। তার ভাষণে প্রমাণীত হয়েছে সু চি রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যাকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে সমর্থন করছেন অথবা সেনাবাহিনীর ক্রীড়নক বা পুতুল হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। যে নেতা জান্তা সরকারের কাছে মাথা নত না করে জাতিকে গণতন্ত্র উপহার দেয়ার শপথ নিয়েছিলেন, যে নেতা নোবেল শান্তি পুরষ্কার গ্রহণকালে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই ‘গণতন্ত্রপন্থী’ নেতার এই মানবিক ও রাজনৈতিক পতন সত্যিই বিষ্ময়কর, দু:খজনক।
সু চি র বক্তব্যের সাথে রাখাইন পরিস্থিতির বাস্তবতার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাখাইনে গণমাধ্যম প্রবেশে সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ি থাকা সত্তে¡ও সেখান থেকে রোহিঙ্গা গণহত্যার যে নারকীয় দৃশ্যাবলী আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। একমাসে চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানের রাখাইন ত্যাগ এবং শত শত রোহিঙ্গা গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা নিয়ে মিথ্যাচার এবং শান্তিকামী বিশ্বের সাথে নিষ্ঠুর তামাশা করেছেন সু চি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের সুপরিকল্পিত নিধনযজ্ঞের শিকার হলেও সু চি নাকি জানেন না রোহিঙ্গারা কেন রাখাইন ছেড়ে পালাচ্ছে! তিনি এ বিষয়ে খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন এবং সেনা অভিযান বন্ধ রয়েছে বলেও দাবী করেছেন, অথচ প্রতিদিনই রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। গুলিবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ ও স্বজন হারানো সন্ত্রস্ত মানুষের আহাজারিতে বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্ত এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায়ও চীন, ভারতের মত আঞ্চলিক শক্তিগুলো প্রশ্নবিদ্ধ ও বিষ্ময়কর ভ‚মিকা পালন করে চলেছে। তবে শান্তিকামী বিশ্ব ক্রমে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বিশ্বের দেশে দেশে রোহিঙ্গা জেনোসাইডের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আন্তর্জাতিক গণআদালতে রাখাইনে সংঘটিত ঘটনাবলীর সাক্ষ্য দিচ্ছেন বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীরা। মান্দালয়ে জন্মগ্রহনকারি একজন বৌদ্ধ মানবাধিকার কর্মী ড. মং জার্নি রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযানকে হিটলারের ইহুদি নিধনের ঘটনার চেয়েও নিকৃষ্টতর বলে আখ্যায়িত করেছেন। বৃটিশ সরকার ইতিমধ্যে মিয়ানমার বাহিনীর প্রশিক্ষণ সহায়তা স্থগিত করেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের ভাষণে জাতিসংঘ মহাসচিব আবারো রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্বসহ উপস্থাপন করেছেন। তুরস্ক, ফ্্রান্স, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের নেতাদের বক্তব্যেও রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিং ইস্যু জোরালোভাবে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট ও শরনার্থী পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি জোরালো আবেদন তুলে ধরা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। অং সান সু চি মিথ্যা ভাষণ, মিয়ানমার বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ও বাংলাদেশের উপর ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীর চাপিয়ে দেয়ার প্রেক্ষাপটে বিশ্বসম্প্রদায়কে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থেই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন