সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

উন্নয়ন দ্রুতায়িত করতে দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই

| প্রকাশের সময় : ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশে কম-বেশি উন্নয়ন কার্যক্রম সবসময়ই চলে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়ন কর্মকান্ড দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া এবং তা বাস্তবায়নের জন্য যে পরিমাণ দক্ষ জনবল দরকার দেশে তার প্রচন্ড অভাব রয়েছে। এর ফলে বিদ্যমান উন্নয়ন কাজ থমকে যেতে পারে। শ্লথ হয়ে যেতে পারে। অর্থনৈতিকভাবেও দেশ ক্রমে পিছিয়ে পড়বে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত ‘সমসাময়িক বিশ্বে বাণিজ্য ও ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক দুই দিন ব্যাপী আয়োজিত এক সেমিনারে অর্থনীতিবিদরা তাদের এই মতামত তুলে ধরেন। তারা বলেন, জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তুলতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়বে। সেমিনারে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাবিদরা অংশগ্রহণ করে তাদের মতামত তুলে ধরেন। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক চিত্র তুলে ধরে বলেন, উন্নয়ন ও অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হলে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং কাজে লাগানোর বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে বিপুল জনশক্তি রয়েছে। জনসংখ্যার ষাট ভাগের বেশি তরুণ। এত বিপুল তারুণ্য নির্ভর জনশক্তি বিশ্বের খুব কম দেশে রয়েছে। তবে এদের মধ্যে সিংহভাগই অদক্ষ এবং বেকার। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বেশি। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছরই হাজার হাজার শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই দীর্ঘ সময় ধরে বেকার জীবনযাপন করে। পাস করেই তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে না। এর মূল কারণই হচ্ছে, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাব। তারা পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষিত হয়েছে ঠিকই, তবে কর্মজীবনে এ শিক্ষা কোনো কাজে আসছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা করানো হলেও সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের চাকরি বা কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ নেই। এখন দেখা যায়, নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদাভাবে সায়েন্স, আটর্স বা বাণিজ্য শাখার প্রার্থী চায় না, শুধু উচ্চ ডিগ্রী সম্পন্ন সার্টিফিকেটধারী হলেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে প্রার্থীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান দক্ষ না হলে নিয়োগ দেয় না। এর ফলে দক্ষ জনবলের অভাবে একদিকে যেমন উন্নয়ন কর্মকান্ড গতি হারাচ্ছে, তেমনি লাখ লাখ তরুণ বেকার থেকে যাচ্ছে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশি জনবল নিয়োগ দিতে দেখা যায়। এক ভারত থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখেরও বেশি কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এতে দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবী, দেশে তাদের কাক্সিক্ষত দক্ষ জনবল না পাওয়া। আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর অনেক জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এদের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যক অদক্ষ রয়েছে। ফলে বিদেশ গিয়ে তাদের নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অনেককে মানবেতর জীবনযাপনের মুখোমুখি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি বছর অনেক শিক্ষিত তরুণ বিদেশে পড়াশোনা করতে দেশ ত্যাগ করছে। সেখানে পড়াশোনা করে দক্ষতা অর্জন করলেও তারা আর দেশে ফিরে আসে না। সেখানেই তারা কর্মে নিয়োজিত হয়ে পড়ে। এর কারণ তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত কর্মসংস্থান ও কর্মপরিবেশ না পাওয়া। অর্থাৎ বিদেশে উচ্চ শিক্ষা অর্জনকারি দক্ষ জনশক্তি কাজে লাগানোর মতো কর্মসংস্থান গড়ে তোলার উদ্যোগের অভাব রয়েছে। এদের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যদি দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে যুক্ত করা যেত, তবে দেশের অর্থনীতি গতিশীল হয়ে উঠত। আমাদের দ্রুত উন্নয়নের জন্য তারা হয়ে উঠত নিয়ামক শক্তি। অন্যদিকে আমাদের যে বিপুল জনশক্তি অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে, তা পরিকল্পিত উপায়ে কাজে না লাগাতে পারায় তা ধীরে ধীরে দেশের বোঝায় পরিণত হচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে গেলে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্যতম উপায় হচ্ছে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের বিনিয়োগের চিত্র খুবই হতাশাজনক। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ বিভিন্ন শিল্পবান্ধব সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যাবশ্যক। এতদিন বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিনিয়োগ হচ্ছে না। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত থাকার পরও বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটেনি। এতে বোঝা যায়, সরকারের উন্নয়ন ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। এ দুর্বলতার প্রভাবে কর্মসংস্থান স্থবির হওয়ার পাশাপাশি বেকারত্বের হার উর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষিত ও অদক্ষ বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এদের দক্ষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জোরালো পদক্ষেপ না থাকায় দক্ষ জনশক্তিও গড়ে উঠছে না। এমনকি বেকার জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে কাজে লাগানোর উদ্যোগেরও অভাব রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, উন্নয়ন সহায়ক দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারকে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিপুল কর্মোপযোগী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কর্মোদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। তা নাহলে উন্নয়ন কর্মকান্ড যেমন স্থবির হয়ে পড়বে, তেমনি বিপুল বেকারের বোঝা উপর চেপে বসবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন