বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও অনলাইন আইরিশ ইন্ডিপেন্ডেটের খবরে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ঠেকাতে ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। তারই অংশ হিসাবে সে সীমান্তে মরিচ ও স্ট্যান গ্রেনেড ব্যবহার করছে। খবরে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীকে রোহিঙ্গা প্রবেশ রোধ ‘রুড অ্যান্ড ক্রুড’ পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। নয়াদিল্লীতে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, প্রবেশের চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের আমরা মারাত্মকভাবে আহত করতে বা গ্রেফতার করতে চাই না। তবে ভারতের মাটিতে রোহিঙ্গাদের সহ্য করবো না। পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হলে আমরা গ্রেনেড ব্যবহার করবো। নির্বিচার গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের মুখে পালিয়ে আসা বিপন্ন রোহিঙ্গাদের প্রবেশ রোধে ভারতের এই নীতি-পদক্ষেপ চরম অমানবিকতার পরিচায়ক। গত একমাস ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা যে পোড়ামাটি নীতি, বর্বরতা ও নৃশংসতা প্রদর্শন করছে বিশ্বব্যাপী তাকে গণহত্যা ও এথনিং ক্লিনজিং বলে অভিহিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণআদালতের রায়ে বলা হয়েছে, দেশটিতে যা ঘটছে তা একাধারে যুদ্ধাপরাধ ও জাতিগত উৎসাদন। এজন্য সেনাবাহিনী ও স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে বিশেষভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই এক মাসে নিষ্ঠুর নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এখনো তাদের ঢল থামেনি। প্রতিদিনই দলে দলে নারী-পুরুষ-শিশু আসছে। অং সান সু চি সেনা অভিযান বন্ধ হয়েছে বলে দাবি করলেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সেই দাবি নাকচ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে আগে থেকেই প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। নতুন করে সমসংখ্যাক রোহিঙ্গার আশ্রয়, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বাংলাদেশের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ মানবিক কারণেই এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। পক্ষান্তরে ভারত রোহিঙ্গাদের প্রতি ন্যূনতম মানবিকতা দেখাতেও নারাজ।
ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের সেনা ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের হত্যা-নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৪০ হাজারের মতো ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত হয়েছে। তারা অন্যান্য দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের মতোই সেখানে আছে। অথচ ২৫ আগস্ট রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ভারত ঘোষনা করে, সে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাবে। এই অবস্থান থেকে ভারত এখনো সরে আসেনি। এ মুর্হূতে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠালে তাদের কি পরিণত হবে বা হতে পারে, তা আন্দাজ করা মোটেই কঠিন নয়। যে কারণে মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা গণহত্যা, গণনির্যাতন ও গণবিতাড়নের শিকার, সেই একই কারণে ভারত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাতে চায়। সেই কারণটি হলো, রোহিঙ্গারা মুসলমান। মুসলমান না হয়ে তারা যদি অন্য কোনো ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর লোক হতো তাহলে মিয়ানমারে তাদের এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতো না। একইভাবে ভারতও সেখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের এই দুর্দিনে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাতে জেদ ধরতে পারতো না। ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বৌদ্ধ ধর্মালম্বী কিরণ রিজজু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরৎ পাঠানোর ঘোষণা দিলে রোহিঙ্গাদের তরফে বলা হয়, তাদের মিয়ামনারে পাঠানোর চেয়ে হত্যা করা হোক। তাদের এই মর্মান্তিক উচ্চারণ ভারতের ক্ষমতাসীনদের মনে কোনো শুভবোধ জাগ্রত করতে পারেনি। শুধু কি তাই? ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছে। বলেছে, তাদের সঙ্গে নাকি আইএস’র সম্পর্ক আছে। এই অভিযোগ মোটেই সত্য নয় বলে দাবি করেছে রোহিঙ্গারা। তারা এমন কি ভারতের সুপ্রিমকোর্টে একটি হলফনামা দাখিল করেছে। হলফনামায় তারা বলেছে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের কোনো যোগ নেই। বরং তিব্বত ও শ্রীলংকা থেকে আসা শরণার্থীদের মতই তারা।
একটি বহুল প্রচালিত প্রবাদ আছে, যার ভাবার্থ হলো: তাকে একটি খারাপ নাম দাও এবং হত্যা করো। এই নীতিটাই মিয়ানমার ও ভারত অবলম্ববন করেছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েই হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন করছে। একইভাবে ভারতও আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাতে চাইছে। সীমান্তে প্রবেশ রোধে মরিচ ও গ্রেনেড ব্যবহার এবং রুড অ্যান্ড ক্রুড নীতি অবলম্বন তারই ধারাবাহিকতা। অত্যন্ত দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, রাখাইনে নেয়া মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর পোড়ামাটি নীতির প্রতি ভারত প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারে হাজির হয়ে অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করে এই সমর্থন জানিয়ে এসেছেন এবং মিয়ানমারকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। অং সান সু চিও নরেন্দ্র মোদির সমর্থন ও আশ্বাসে গদগদ হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ওয়াকিবহাল মহল লক্ষ্য করছে, বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও এথনিং ক্লিনজিংয়ের বিরুদ্ধে যখন নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে তখন ভারত নিশ্চুপ । শুধু তাই নয়, মিয়ানমারকে তলে তলে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে। গণহত্যার অভিযোগে বৃটেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক ছেদ করেছে। ঠিক একই সময়ে ভারত মিয়ানমারকে সামরিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনা করছে। ভারতের এই আলোচনার লক্ষ্য অস্ত্রশস্ত্র বিক্রী করা। বলা বাহুল্য, এর সঙ্গে শুধু অস্ত্রবাণিজ্যেরই সম্পর্ক নেই, নীতিগত ঐক্যের বিষয়টিও যুক্ত আছে। ভারত ও মিয়ানমারের এই বর্ণবাদী ও মুসলিম বিদ্বেষী নীতির অভিন্নতা এ অঞ্চলের জন্য নি:সন্দেহে উদ্বেগজনক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন