লিভারের বা যকৃতের বিভিন্ন অসুখের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে রোগটি হয়, তা জন্ডিস নামে পরিচিত। জন্ডিস আসলে কোনো রোগ নয়। এটি রোগের লক্ষণ। অনেকেই জন্ডিসকে রোগ ভাবেন। এটি একেবারেই ভুল। লিভার বা যকৃতের সমস্যা হলে জন্ডিস হয়। তবে লিভারের সমস্যা ছাড়াও জন্ডিস হতে পারে। নানা কারণে লিভার বা যকৃতে জটিলতা হতে পারে। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস অন্যতম।
হেপাটাইটিস ‘ই’ পানিবাহিত একটি ভাইরাস। দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে মহামারি আকার ধারণ করে। ফুটপাতের খাবার, শরবত বা ফলের রস খেলে এই ভাইরাস শরীরে ঢোকে। তারপর লিভারে যেয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। হয় জন্ডিস। হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগী ওষুধ ছাড়াই ভালো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটি যকৃতকে নষ্টও করতে পারে। তবে আশার কথা এ ধরনের জটিলতা খুব বেশি হয় না। তারপরেও যেহেতু জটিলতা হতে পারে তাই সাবধান হতেই হবে।
বিভিন্ন ভাইরাস আছে যেগুলো মানবদেহে ঢুকে লিভারের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এগুলো হলো হেপাটাইটিস ‘এ’, হেপাটাইটিস ‘বি’, হেপাটাইটিস ‘সি’, হেপাটাইটিস ‘ডি’ ও হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস। লিভার ক্যান্সার আর লিভার সিরোসিসের জন্য দায়ী হেপাটাইটিস ‘বি’, হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস। হেপাটাইটিস ‘ই’ দিয়ে লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যন্সার হয় না। তবে জটিলতা হতে পারে। বাংলাদেশে জন্ডিসের অন্যতম প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস। তবে এই ভাইরাসে স্বল্পমেয়াদি লিভার প্রদাহ হয়। দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ হয় না।
হেপাটাইটিস ‘ই’ যেকোনো বয়সের মানুষেরই হতে পারে। তবে পনের থেকে চল্লিশ বছর বয়সী ব্যক্তিরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ ছাড়াও এ রোগ দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় এই ভাইরাস বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
‘ই’ ভাইরাস শরীরে ঢোকার সাথে সাথেই রোগ সৃষ্টি করে না। মোটামুটি এক মাস পর রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। রোগটিতে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায়। যেমন-
১। জন্ডিস, ২। খাবারে অরুচি, ৩। পেটে ব্যথা
৪। বমি বমি ভাব কিংবা বমি, ৫। অল্প জ্বর প্রভৃতি উপসর্গ থাকতে পারে।
এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথম দিকে অল্প অল্প জ্বর, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব হওয়া, চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, জিহ্বার নিচের দিকে হলুদ হয়ে যাওয়া, গাঢ় প্রস্রাব ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
হেপাটাইটিস ‘ই’ নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য রোগীর রক্তের সিরামে এ ভাইরাসের নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখা হয়। এ ছাড়া সিরাম বিলিরুবিন ও লিভার ফাংশন টেস্ট করা হয় লিভারের অবস্থা দেখার জন্য। বিভিন্ন পরীক্ষা করে সহজেই এই রোগ ধরা যায়।
হেপাটাইটিস ‘বি’ হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের মতো হেপাটাইটিস ‘ই’ লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সার সৃষ্টি করে না। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ভালভাবে বিশ্রাম নিলে এমনিতেই রোগ সেরে যায়। স্বাভাবিক খাবার খেতে হবে। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়। রোগীর বমি বা বমি ভাব হলে অ্যান্টি-ইমেটিক্ দেয়া হয় এবং ক্ষুধামন্দার কারণে ভিটামিন আর পায়খানার সমস্যা হলে পায়খানা পরিষ্কারের জন্য ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। হেপাটাইটিস রোগীর ক্ষেত্রে পায়খানা পরিষ্কার হলে রোগী ভালো থাকে। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীকে ব্যথার, ঘুমের এবং কবিরাজি ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে, কারণ এগুলো লিভারের ক্ষতি করে।
হেপাটাইটিস ‘ই’-এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। কোনো কার্যকর ভ্যাকসিনও নেই। তবে গবেষণা চলছে। এই ভাইরাসকে অবহেলা করার কোনো উপায় নেই। কারণ লিভার ফেইলিওরের অন্যতম কারণ হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস। বিশেষ করে গর্ভবতী মা এবং আগে থেকে লিভার রোগে আক্রান্ত কারো যদি হেপাটাইটিস ‘ই’ হয় তাদের ক্ষেত্রে লিভার ফেইলিওরের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। এমনকি আগে থেকে লিভার রোগ নেই এমন ব্যক্তির বেলায়ও লিভার ফেইলিওরের অন্যতম কারণ হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস। এর ফলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
হেপাটাইটিস ‘ই’ থেকে বাঁচতে হলে এ রোগ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এটি একটি পানিবাহিত রোগ, তাই এ রোগ প্রতিরোধের জন্য সব সময় পানি ফুটিয়ে পান ও ব্যবহার করতে হবে। এতে শুধু হেপাটাইটিস ‘ই’ নয়, বরং টাইফয়েড আর ডায়রিয়ার মতো আরো অনেক পানিবাহিত রোগ থেকেও বাঁচা যাবে। খাওয়ার পানি ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট ফোটালেই হেপাটাইটিস ‘ই’-এর জীবাণু মারা যায়। খাবার আগে ও পায়খানা থেকে ফেরার পর হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। ব্যক্তিজীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করা উচিত। ফুটপাতের খাবার বর্জন করতে হবে। একটু সচেতন হলেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায় ।
ষ ডা. হারুন অর-রশিদ
ষ ডা. ফজলুল কবির ভূঁইয়া
লিভার রোগ বিভাগ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন