শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

উল্টোপথে প্রভাবশালীদের গাড়ী

প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৫ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

রাজধানীর যানজট একদিকে যেমন নগরবাসির নিত্য দুর্ভোগের কারণ, অন্যদিকে তা অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও বড় অন্তরায়। রাজধানী শহরে অস্বাভাবিক যানজট দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ, বাণিজ্য, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং পর্যটনের মত বিষয়গুলোতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এ শহরের যানজট নিরসনে গত দু’ তিন দশকে নানা প্রকল্প ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এসব উদ্যোগের বাস্তব ফলাফল পাওয়া যায়নি। যানজট নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বড় বড় ফ্লাইওভার নির্মানের পরও এয়ারপোর্ট থেকে মতিঝিল পৌঁছতে কমপক্ষে দুই ঘন্টা সময় লাগে। গতিশীল হাইওয়েতে দূরত্বের নিরীখে তা ২০ মিনিটের বেশী সময় লাগার কথা নয়। ঢাকার যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ রাস্তা ব্যবহারকারিদের বেপরোয়া ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও যখন ট্রাফিক ব্যবস্থায় কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছেনা, তখন ট্রাফিক আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতি মনোযোগ দিতেই হচ্ছে। ট্রাফিক আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডিএমপি মাত্র দু’টি রাস্তায় নজরদারি শুরু করার দুইদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও উল্টোপথে চলাচলকারী গাড়িগুলোর বেশীরভাগই সরকারের প্রভাবশালী মহলের। এ ধরনের ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের ঘটনায় ট্রাফিক পুলিশের হাতে আটক হওয়া অর্ধশতাধিক গাড়ির মধ্যে সরকারের প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পুলিশ এবং আদালতের বিচারকদের গাড়িও রয়েছে। আটককৃত গাড়ীর মধ্যে এমন প্রভাবশালীদের সংখ্যা শতকরা ৭০ ভাগের বেশী বলে জানা যায়।
যারা দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকেন। যারা আইন প্রণয়ন করেন, আইনের বাস্তবায়ণ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকেন এবং জনগনের ট্যাক্সের টাকায় বেতন-ভাতা ও রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি ভোগ করে থাকেন, তারাই যত্রতত্র আইন অমান্য করে রাস্তায় যানজট ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। এমনিতেই নগরীতে ভিভিআইপিদের চলাচলের প্রটোকলে প্রায় প্রতিদিনই নাকাল হচ্ছেন নগরবাসী। তার উপর সরকারের মন্ত্রী-আমলা ও রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের মচ্ছবে সাধারণ নাগরিকরাও প্রভাবিত হচ্ছে। বিশ্বের আর কোন দেশে সরকারের মন্ত্রী, আমলাসহ এলিট শ্রেনীর এমন বেপরোয়া আইন লঙ্ঘনের নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই। শহরের শতকরা আশিভাগের বেশী কর্মজীবী মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াত করেন। অবশিষ্ট সংখ্যালঘিষ্ট অংশের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রী, এমপি, আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা ও বড় ব্যবসায়ীরা। এদের ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও উল্টোপথে বেপরোয়া গাড়িচালনার কারণে শহরে পুরো পরিবহন ব্যবস্থায় নৈমিত্তিক স্থবিরতা ও অচলাবস্থা দেখা দেয়। রাজপথে গাড়ি চলাচলে এঁদের আইন অমান্যের প্রবণতা রোধ করা না গেলে যানজট নিরসন ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে অন্য সব উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হতে বাধ্য। ডিএমপি প্রথমবারের মত যে অভিযান শুরু করেছে এবং এতে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমদাশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের যে নজির সৃষ্টি হয়েছে তা’ খুবই ইতিবাচক। তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এই ব্যবস্থাও যথেষ্ট নয়। কারণ প্রথম দিনে আটক হওয়া একজন সরকারী কর্মকর্তার গাড়ি দ্বিতীয় দিনেও উল্টোপথে চলতে দেখা গেছে।
নাগরিক সচেতনতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া ছাড়া নাগরিক শৃঙ্খলা, রাজপথের গতিশীলতা, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এখনো শহরের বেশীরভাগ রাস্তায় ফুটপাথ নেই। যে সব রাস্তায় ফুটপাথ আছে তা অবৈধভাবে হকারদের দখলে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল ফুটপাথ দখল করে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করছে। অন্যদিকে একশ্রেনীর বেপরোয়া মটরবাইক চালক শাস্তিযোগ্য আইন এবং আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অমান্য করেই প্রতিদিন ফুটপাতে মটরবাইক চালিয়ে পাবলিক ন্যুইসেন্স সৃষ্টি করছে। শিক্ষিত, সচেতন ও অর্থনৈতিক সুবিধাভোগি শ্রেনীর এমন আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ও দৃশ্যমান শাস্তির বিধান থাকা আবশ্যক। শুধু আইন থাকলেই হবেনা। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক আইনের এমন আনুষ্ঠানিক ও পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অবস্থার বাস্তব ও স্থায়ী উন্নতি আশা করা যায়না। যানজট নিরসন ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে ফুটপাথে সরকারী,বেসরকারী ও ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংসহ সব রাস্তায় সার্বক্ষণিক মনিটরিং জরুরী। বিশেষত: প্রভাবশালী মহলের ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও উল্টোপথে গাড়ি চালনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অব্যহত রাখতে হবে। মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী মহল আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে সাধারণ নগরবাসি ও গণপরিবহণ ব্যবহারকারিরা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। উল্টোপথে গাড়ি চালনা প্রতিরোধে ডিএমপি’র এই অভিযানের সাথে দুর্নীতিদমন কমিশন চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত নজরদারির ঘটনাও একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে ঢাকার যানজট সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়, আইন মান্য করে এবং সকলের উপর আইনের সমান প্রয়োগ করে এটা প্রমান করার মূল দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন