রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশ্বজনমত অনেকটা একই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এই সংকট মোকাবেলায় জাতিসংঘসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো একমত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়া ও অবিলম্বে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতা বন্ধ করার জোর তাকিদ দিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরাস রাখাইনে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার আহŸান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে উপর্যুপরি আহŸান জানানো সত্তে¡ও মিয়ানমারের অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ না হওয়ায় ক্ষুদ্ধ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘদিন নীরব থাকা চীনও রাখাইনে দ্রæত স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ও সংকট নিরসনে সব পক্ষকে এগিয়ে আসার আহŸান জানিয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সংলাপও চেয়েছে দেশটি। গত ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশস্থ চীনের রাষ্ট্রদূত মিংকিয়াং বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চীন গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীন পরস্পর উন্নয়ন কর্মকাÐের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন ভূমিকা রাখবে। নিরাপত্তা পরিষদে পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় আশা করা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
রোহিঙ্গা সংকটের শুরুতে চীন মৌনতা অবলম্বন করায় দেশটির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এক্ষেত্রে সে বাংলাদেশ ও মায়নমারের সাথে তার সম্পর্ক বিবেচনায় মাঝামাঝি অবস্থান নেয়। এর কারণ উভয় দেশেই তার ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত ব্যাপক স্বার্থ রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী মায়ানমারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠায় চীন নীরবতা ভেঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য পন্থা অবলম্বনের কথা বলে। বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফরে গেলে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ চীন আশ্বস্ত করে বলেছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একটি স্থায়ী উপায় অবলম্বনের ক্ষেত্রে সে মিয়ানমারকে বোঝাবে। চীনের এই অবস্থান পরিবর্তন এবং নিরাপত্তা পরিষদে তার বক্তব্যের কারণে আশা করা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হবে। তার আলামতও ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মিয়ানমার সফর করে আসা ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড বলেছেন, অং সান সু চি বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চান। গত বৃহ¯পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সুচি এ ব্যাপারে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট কক্সবাজার সফর করে বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করার জন্য তার দেশ কাজ করছে। জাপানের রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তা পরিষদে তার বক্তব্যে বলেছেন, রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জাপান উদ্বিগ্ন। তিনি অং সান সুচিকে কফি আনানের সুপারিশ বাস্তবায়নের তাকিদ দেন। অবশ্য জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, চীন ও রাশিয়া মানবিক সঙ্কটে, মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে, মানবতার, সত্য-ন্যায় ও যৌক্তিকতার পক্ষে অবস্থান নেবে বলে আশা করি। দ্বিচারিতা আমরা আশা করি না। একদিকে সাহায্য, অন্যদিকে অত্যাচারী ঘাতকদের সমর্থন দ্বিচারিতা। এ আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়। বলা বাহুল্য, নিরাপত্তা পরিষদে চীনের আরও জোরালো ভূমিকা বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আশা করেছিল। মিয়ানমার যেমন তার বন্ধু, বাংলাদেশও তার বন্ধু। যেখানে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন জড়িত, সেখানে ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করাই উচিত। এ হিসাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার পাওয়া স্বাভাবিক। আমরা আশা করব, চীন বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূমিকা সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং প্রশংসিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশে যেভাবে বাংলাদেশ দাঁড়িয়েছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। বিশ্বের মানুষও তা ইতোমধ্যে জেনেছে। বাংলাদেশ যে শুধু ঝড়-ঝঞ্ঝার দেশ নয়, মানবতার পাশে দাঁড়িয়ে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টিারী দেশও বটে, তা আজ বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। এতে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটি ভাল ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে, এই ইমেজ কাজে লাগিয়ে বিশ্ব দরবারে নিজেকে মর্যাদার উচ্চতম শিখরে উন্নীত করা। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার এ এক অপূর্ব সুযোগ। যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তাই কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি এবং কৌশল অবলম্বন করে চীনকে সাথে নিয়ে এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি মিয়ানমারের সাথেও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। উপর্যুপরি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের নমনীয় হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট প্রতিভাত হয়েছে, সুচির আশ্বাসে। যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য সমাধান না হওয়ার পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ চাপ অব্যাহত ও জারদার রাখতে হবে। সকলেই একমত, রোহিঙ্গাদের ন্যায়সঙ্গত যাবতীয় অধিকারসহ স্বদেশ প্রত্যার্বতন ও প্রতিষ্ঠাই উদ্ভূত সমস্যার একমাত্র সমাধান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন