শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সংশ্লিষ্টদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই

প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে অনলাইন ব্যাংকিং চ্যানেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনা দেশ-বিদেশে বহুমুখী প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় ধরে এই চাঞ্চল্যকর চুরির ঘটনা খোদ সরকারের অর্থমন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের কাছে পর্যন্ত গোপন রাখার কারণে নানা ধরনের স্পেকুলেশনের ডালপালা বিস্তৃত হচ্ছে। দেশে-বিদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের আলোচনা উঠে আসছে, সেসব আলোচনার যুক্তি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অনেক কিছুই টাকা চুরির ঘটনার তদন্তে প্রণিধানযোগ্য হতে পারে। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা গেল, প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনার ৪০ দিন পর অবশেষে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব ও বাজেট বিভাগের যগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ধারায় মঙ্গলবার মতিঝিল থানায় রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত এজাহারটি দায়ের করেছেন। নানা মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে সারাবিশ্বের মানুষ ইতোমধ্যেই জেনে গেছে, ফেব্রুয়ারির ২ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে এফআরবিএনআই থেকে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার ব্যাংকের মাধ্যমে কোটি ডলার বেহাত হয়ে গেছে। তবে মামলার বিবরণীতে আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাক অফিস ডিলিং রুমের স্বয়ংক্রিয় প্রিন্টারের ত্রুটি এবং অননুমোদিত লেনদেনের বিষয়টি প্রথমে ৫ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নজরে পড়ার পর এতদসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে কিছু উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের শত মিলিয়ন ডলার চুরি হওয়ার ঘটনায় নিউ ইয়র্ক, ম্যানিলা থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে যখন তোলপাড় চলছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান তখন ভারত ভ্রমণে ছিলেন। বস্তুত অনলাইন ব্যাংকিং চ্যানেলে বিশ্বব্যাপী অর্থ লেনদেন বাড়ার সাথে সাথে সিস্টেম হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার চুরির ঘটনা ঘটলেও কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে শত মিলিয়ন ডলার বেহাত হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। আর এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর তা সরকারের দায়িত্বশীল মহলের কাছে গোপন রাখা বা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা ততোধিক নজিরবিহীন ও বিস্ময়কর। বেহাত হওয়া ১০ কোটি ডলারের মধ্যে কোটি ডলার ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে ছাড় হওয়ায় এ বিষয়ে তদন্ত ও আলোচনার জন্য ফিলিপাইনের সিনেটে বিশেষ অধিবেশন ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানা যায়। ডলার চুরির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জরুরি বোর্ড সভা আহ্বান না করে ভারত সফরে যাওয়ার বিষয়টিও নানা ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভারত থেকে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের সাথে কথা বলেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। এরই মধ্যে টাকা চুরির ঘটনা তদন্তের জন্য ভারত থেকে রাকেশ আস্তানাকে ডেকে আনা হয়েছে। উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনায় গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেছেন। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি সেক্টরের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্স এবং তার প্রধান নির্বাহী রাকেশ আস্তানাও দায় এড়াতে পারে না।
রিজার্ভ ব্যাংক থেকে টাকা চুরির নৈতিক দায় নিয়ে নিজের পদত্যাগের প্রতিক্রিয়ায় বিদায়ী গভর্নর ড. আতিউর রহমান ‘বীরের বেশে যাচ্ছি’ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আতিউরের পদত্যাগকে সৎসাহসের বিরল দৃষ্টান্ত বলে প্রশংসা করেছেন। ইতিপূর্বে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত টাকা চুরির ঘটনা তার কাছে দীর্ঘদিন গোপন রাখার ‘ধৃষ্টতার’ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বিবি’র দুই ডেপুটি গভর্নরসহ ৭ জনকে অপসারণ এবং রিজার্ভ শাখার ১২ কর্মকর্তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখার খবর প্রকাশিত হয়েছে। চাপে ফেলে অথবা নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে পদত্যাগের মধ্য দিয়ে গভর্নর আতিউর রহমান জবাবদিহিতার বাইরে থাকতে পারেন না। উল্লেখ্য, নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ছাড়ের জন্য ঢাকা থেকে ৩৫টি সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল, ৫টি নির্দেশ বাস্তবায়িত হওয়ার পর ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় বাকি চেকগুলো আটকে দেয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৭ হাজার কোটি টাকা রক্ষা পায়। তদন্তের স্বার্থে এখনো অনেক কিছুই গোপন রাখছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে ইতোমধ্যে যেসব বিষয় প্রকাশিত ও আলোচিত হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ‘সর্ষের ভূত’ চিহ্নিত করা অসম্ভব নয়। একইভাবে বিগত সাত বছরে দেশ থেকে চার লক্ষাধিক কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার দায়ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন না। মিথ্যা ঘোষণা, আন্ডারইনভয়েসিং, ওভারইনভয়েসিংসহ নানাভাবে লক্ষ কোটি টাকা পাচারের সেসব ঘটনারও অনুপুঙ্খ তদন্ত ও দোষীদের বিচার হওয়া আবশ্যক। পদত্যাগ বা অপসারণই সমাধান নয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগার রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন