স্থাপত্য
কথায় আছে, ৬৪ খ্রীষ্টাব্দে রোম নগরী যখন পুড়ে ছারখার হচ্ছিল তখন স¤্রাট নিরো আনমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে নিজের লেখা কবিতাবৃত্তি করছিলেন। রাজ্য পরিচালনা থেকেও বেশী পছন্দ করতেন প্রজাদের দেখাতে যে তিনি একাধারে কবি, আবৃত্তিকার, নাট্যকার, যন্ত্রশিল্পী ও সারথী। রোম নগরীর সৌন্দর্য, মহিমা, ঐতিহ্য, ধ্বংস ও পুন:সৃষ্টি সম্পর্কে বলার আগে স¤্রাট নিরো সম্পর্কে কিছু আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
নিরো যার পুরো নাম নিরো ক্লডিয়াস গাষ্টাস জার্মানিকাস। জন্ম ১৪ ডিসেম্বর ৩৭ খ্রীষ্টাব্দ। ৪০ খ্রীষ্টাব্দে পিতা মারা যান। যাবার পর মাতা এগ্রিপ্পিনা তাকে লালন পালন করেন, যিনি স¤্রাট অগাষ্টাসের নাতনী ছিলেন। নিরোর মাতা তার দ্বিতীয় স্বামীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে চাচা স¤্রাট ক্লডিয়াসকে বিয়ে করেন। নিরোকে রোম রাজ্যের উত্তরাধিকারী তৈরির এবং স¤্রাট অগাষ্টার মেয়ে অক্টাভিয়ার সাথে নিরোর বিয়ের ব্যাপারে স¤্রাটকে নানাভাবে প্রভাবান্বিত করতে থাকেন।
নিরোর মাতা এগ্রিপ্পিনা ৫৪ খ্রীষ্টব্দে স¤্রাট ক্লডিয়াস ও ৫৫ খ্রীষ্টাব্দে ক্লডিয়াসের ছেলে ব্রিটান্নিকাসকে বিষ প্রয়োগে নির্বিঘেœ হত্যা করতে সমর্থ হন। স্বভাবতই নিরো বিশাল স¤্রাজ্যের স¤্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হন। প্রাথমিকভাবে নিরো তার দয়া, ক্ষমা ও প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে সা¤্রাজ্য পরিচালনা করেন। কিন্তুু দ্বিতীয় পর্যায়ে তার মাতা রাজ্য পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করায় নিরোর আসল স্বরূপ উদভাসিত হয়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ৫৯ খ্রীষ্টাব্দে নিরো তার গর্ভধারিণী মাতাকে এবং ৬২ খ্রীষ্টাব্দে স্ত্রী অক্টাভিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রেমিকা পপ্পায়া সাবিনাকে বিয়ে করেন। সাবিনাকে বিয়ে করার কিছুদিন পরই নিরো আবার উদাসীন ও প্রজাদের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন। ৬৪ খ্রীষ্টাব্দে রোম যখন পুড়ে ধ্বংস হচ্ছিল তখন নিরো তাচ্ছিল্যের সাথে যন্ত্রসঙ্গীত ও কবিতাবৃত্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন নিরোই নিজে ধ্বংস করার জন্য আগুন লাগিয়েছিলেন এবং সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য বহু খ্রীষ্টানকে প্রকাশ্যে নিধন করেন।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এই নিরোই আবার রোমকে তিলে তিলে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। নিরোর ‘গোল্ডেন হাউস’ বিশ্বের সর্বকালের সৌন্দর্যমÐিত আড়ম্বরপূর্ণ স্থাপত্য শিল্প হিসাবে পরিচিত লাাভ করে। ৬০ খ্রীষ্টাব্দের প্রথমদিক থেকেই ব্রিটেন, ফ্রান্স ও স্পেনের বিভিন্ন দল-উপদল নিরোর বিরুদ্ধে চলে গিয়ে বিদ্রোহ করে। পরবর্তী পর্যায়ে রোমান সিনেট নিরোকে ভৎসনা করে এবং মৃত্যু পরোয়ানা জারী করে। সর্বশেষে ৬৮ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে বিশাল রোম সা¤্রাজ্যের অধিপতি পঞ্চম স¤্রাট আত্মহত্যা করে জীবনাবসান ঘটান।
যার প্রতিটি রক্ত কণায় সৃষ্টি নিরো, যার উদ্যম, প্রচেষ্টা এবং উন্মাদনায় নিরো বিশাল সা¤্রাজ্যের অধিপতি হলেন, যে মাকে শ্রদ্ধা, ভয় ও অনুসরণ করতেন সে মাকে নিরো হত্যা করেছে নিদ্বির্ধায়। অপরদিকে যে রোমকে পুড়িয়ে মনের মাঝে নির্মম সুখ অনুভব করেছেন আবার সেই রোমকে সৃষ্টি করেছেন অধীর আগ্রহ নিয়ে অনুপম সৌন্দর্যে।
তাই প্রথম দর্শনেই রোমকে মনে হবে চিত্র এবং স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব মিলনমেলা। ধ্বংস এবং সৃষ্টির এ যেন এক অপরূপ খেলা। প্রায়শই যেতে যেতে দেখা যাবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিধ্বস্ত অনেক ইমারতের সৌকর্যমÐিত পিলার অথবা অংশ বিশেষ। এই রোম নগরীতেই অবস্থান করছে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম সার্বভৌম রাষ্ট্র ভেটিক্যান। সেন্ট পিটার স্ক্যোয়ার, সেন্ট পিটার বেসিলিকা, বিশ্বখ্যাত কলিসিয়াম পৌরাণিক স্থাপত্য শিল্পেরর ল্যান্ডমার্ক রোমান ফোরামের ধ্বংসাবশেষ।
ভেটিক্যান সিটির একটি নির্দিষ্ট জানালায় পোপ এসে দাঁড়িয়ে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন ও ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ছোট্ট জায়গা কিন্তু এত বিশাল তত্ত¡ ও তথ্য বহুল প্রাচীন শিল্প দেখতে হলে হাতে ২/৩ দিন সময় নিয়ে দেখতে হবে। পোপের চেয়ে বড় ধর্মীয় নেতা পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন নেই। পোপের উত্থান-পতন নির্বাচন নিয়ে ভেটিক্যানে চলে জীবন মৃত্যুর অপূর্ব খেলা।
ইটালীতে বাংলাদেশীরা :
সম্ভবত : লন্ডন, নিউইয়র্কের পরেই রোম হচ্ছে বাংলাদেশীদের ভাগ্য অন্বেষণের তীর্থস্থান। বাংলাদেশীরা বেশ ভালো আছেন সেখানে। চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী সেখানেও সংগঠন অসংখ্য। আমি ও আমার স্ত্রী তাহমিনা যেদিন রোম থেকে রওয়ানা হবো সেদিন সন্ধ্যায়ই বাংলাদেশের সাবিনা ইয়াসমিন সহ প্রথমসারির শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। চাচাতো ভাই জিন্নাহ, বিল্লালের পরিবারের সকল সদস্য অনুষ্ঠানের যাওয়ার উত্তেজনায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল ক’দিন থেকেই। ইদানিং রাজনীতিবিদদেরও বেশ আনাগোনা। আওয়ামী লীগ বিএনপি-র মূল ও অঙ্গ সংগঠনসহ সব রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও উপস্থিতি দেখলাম আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির উদ্যোগ এবং বাংলাদেশ সোসাইটি ও মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সোসাইটি আয়োজিত “বাংলাদেশ আর্সেনিক ভয়াবহতা” শীর্ষক সেমিনারে। রোম বাংলাদেশ সোসাইটি ও কয়েকটি সংগঠন ইতালিয়ান পার্লামেন্টের মেম্বার ও অন্যান্য গণপ্রতিনিধির সাথে বেশ ভাল যোগাযোগ রক্ষা করে। সেমিনারে জাতিসংঘের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধি, ইতালিয়ান পার্লামেন্টের সেক্রেটারীর উপস্থিতিসহ বহুসংখ্যক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে আর্সেনিকের ভয়াবহতার উপর প্রামাণ্য চিত্র সকলের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। রোম ছেড়ে আসার আগের দিন ক্যামেরা নিয়ে বের হলাম এখানকার বাঙ্গালীদের খোঁজে। পথে বাংলাদেশের ধাঁচে কাঁচা বাজার দেখে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। নাম জিয়াজ্জা ভিক্টোরিয়া বাজার। ফুটপাতে এখানেও বিভিন্ন দেশের লোক তাদের পসরা সাজিয়ে বসে অস্থায়ীভাবে। পুলিশকে আসতে দেখে ওরা মুহূর্তের মধ্যে দোকান গুটিয়ে ঝটপট চলে গেল আড়ালে। আবার পুলিশকে অন্তর্ধানের সাথে সাথে আগের মত সাজিয়ে বসলো। বাংলা কথা শুনছি এখানে ওখানে। এক মালিককে জিজ্ঞেস করায় বলল, ভাই কঠিন পরিশ্রম তবে সারাদিনই ব্যস্ত বেচা কেনায়। নাম আ: জব্বার মিয়া ওর তিনটা দোকান আছে ওরকম। প্রচÐ ভিড়। প্রায় সবাই ইতালিয়ান খদ্দের। শব্জি ফলফলাদি সবই কিনছে। মহাজনকে সাহায্য করছে আরও দু’জন। নাম আমিন মোড়ল ও আবুল কাশেম। আ: জব্বার মিয়া বললেন বাঙ্গালীদের এরকম একশতের উপর দোকান আছে। কিছু বাঙ্গালীর আছে এলিমেন্টারী অর্থাৎ নিতান্ত প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র-চাল, ডাল, তেল, লবণ ইত্যাদি। মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি প্রিন্সের ঘড়ির দোকান দেখলাম বেশ জমজমাট। এছাড়া কাপড়ের ব্যবসা, ট্রাভেল এজেন্সীসহ নানা ব্যবসায়ই জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশীরা।
আমার নিউউয়র্ক হলিসউডের বাড়িতে প্রতি বছরই প্রায় আলাদা করে একটু জায়গায় পাট বপন করি। স্ত্রীর হরেক রকম শব্জি চাষের একটু অসুবিধা করে হলেও এই পাটই এক সময় বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরি ফসল এবং রপ্তানী উপাদান ছিল। কারণ উৎকৃষ্ট মানের পাটউৎপাদন এই বাংলাদেশেই হত। তাছাড়া শৈশব ও কৈশোরে পাটের সাথে কেমন যেন একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠে ছিল। যেমন ক্ষেতের আইলে রাখা নিড়ানীর মাঝে পাট শাক বাছা নিয়ে প্রতিযোগিতা, নতুন বর্ষায় পাট ক্ষেতে কোঁচ দিয়ে শিং মাছ ধরা, বাতাসহীন অন্ধকার রাতে বড় পাট ক্ষেতের পাশ দিয়ে হ৭াটতে গিয়ে ভয়ে শরীর ঝিমঝিম করা। তাই ছোট্ট পাটগুলোর দিকে জ্যোৎ¯œায়, আমাবশ্যায় অথবা অঝোর বৃষ্টিতে জানালা দিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকি। সেইবার মাত্র দেশ থেকে বেড়াতে আসা শ্যালকের সাথে বাইরে বসে গল্প করতে করতে রাত গভীর থেকে ভোরে পরিণত হওয়ার উপক্রম হল। পূর্ণিমার চাঁদ পুত্র, কন্যা সবাই ঘুমিয়ে। বাড়ির পেছনের অংশটা-গাছ-গাছালি, ফুল সব্জি দিয়ে ঘেরা। হঠাৎ কেন যেন ইচ্ছে হলো (কৈশোরে গ্রামে যেমনটা হত) পাট ক্ষেতে শরীরের তরল নির্যাস নির্গত করার। একটানা গল্প ও পানীয় পানে বেগও ছিল বেশ। একটু আসছি বলে ভরা জ্যোৎ¯œায় মাধূর্য নষ্ট করে (নাকি জ্যোৎ¯œায়কে খিলখিলিয়ে হাসিয়ে দিয়ে) নিজের দেহ ও ইচ্ছাকে হাল্কা করলাম। শ্যালককে প্রতিজ্ঞা করালাম একথা যেন কাউকে না বলে। যা হোক পূর্ণিমা গত হলো। আমাবশ্যায় ঘোর বৃষ্টি হলো। পাট গাছগুলো বিধৌত হয়ে যেন আরও রিষ্ট-পুষ্ট হলো। ছুটির দিন। ছেলেকে নিয়ে প্রতিযোগিতায় করে অনেক পাট শাক তুললাম। দুপুরে খেতে বসেছি। প্রথমেই পাট শাক নিলাম সাথে কাসুন্দি। রসনা তৃপ্ত করতে করতে টেবিলের চারদিকে তাকিয়ে দেখি সবার মুখে দুষ্ট, মিষ্টি মৃদু হাসি। কিন্তুু কেউ পাট শাক নিচ্ছে না। শ্যালকের তো অট্ট হাসি। দ্রæত নত মস্তকে পাট শাক গলধকরণের ব্যস্ত হয়ে ভাবলাম-সুনীলের কবিতার মত শ্যালকও কথা রাখেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন