রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অং সান সুচির উদ্যোগ ইতিবাচক

| প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জঙ্গীরা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা ও নারকীয় বর্বরতা চালানোর ৬৮টি দিন পর রাখাইন রাজ্যের উত্তরাংশে গেলেন স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি। মিয়ানমারে ২০১৫ সালের পর এই প্রথম তিনি সেখানে গেলেন। তার সফরসঙ্গী হিসেবে ছিল সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তা মিলিয়ে প্রায় ২০ জন। অনির্ধারিত সফরে সু চি রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে মংডুতে যান। সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই জেলা। মংডুর মেঠোপথ ধরে যখন তিনি হাঁটছিলেন, তখন তার চারপাশে কেবল ছিল বিধ্বস্ত জনপদ। এ সময় তাকে হাসোজ্জ্বল দেখা যায়। তার এ সফরের আগের দিনও রাখাইন থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ বাংলাদেশে আসতে দেখা গেছে। মংডু সফরে সু চি সেখানের মুসলমান নেতাদের একটি দলের সঙ্গে কথা বলেন। আলোচনায় উপস্থিত এমন একজন নেতাকে উদ্ধৃত করে পর্যবেক্ষক গোষ্ঠী আরাকান প্রজেক্টের ক্রিস লিউয়া বলেন, সু চি জনগণকে শুধু তিনটি বিষয়ের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, তাদের শান্তিতে বসবাস করা উচি, সরকার তাদের সহায়তা করবে এবং তাদের একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করা উচিত নয়।
দুই মাসেরও অধিক সময় ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জঙ্গীদের গণহত্যা এবং জাতিগত নিধন চলাকালীন অং সান সুচি নীরব থেকে এই অপকর্মকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন, তারা বাংলাদেশের নাগরিকÑএ কথাও বলেছেন। এসব কথা বলে তিনি রোহিঙ্গা নিধনকে সমর্থন দিয়েছেন। এ নিয়ে সারাবিশ্বে তীব্র প্রতিবাদ হলেও তার কোনো বিচলন ছিল না। তিনি নির্লিপ্ত ছিলেন এবং টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি গণহত্যা, গণনিয়াতন ও গণবিতাড়নের বিরুদ্ধে। তাকে বলা হয়, ‘ডিফ্যাক্টো’ নেত্রী। যিনি নামে আছেন, তবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম নন। সেনাবাহিনীকে বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো সক্ষমতা তার নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকতেই হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। তারপরও সারাবিশ্ব মনে করে, তিনিই পারেন রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়ন বন্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে। এ নিয়ে তার উপর চাপও সৃষ্টি হয়। তার নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নেয়ার জন্য জনমত গড়ে তোলা হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার ছবি সরিয়ে নেয়া হয়। বিশ্বব্যাপী তার প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা সৃষ্টি হয়। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তোপের মুখে পড়তে পারেন, এ আশঙ্কায় সেখানে যোগ দেননি। এত কিছুর পরও তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেও তাতে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মিয়ানমার সফরে গেলে, সফরটি বলতে গেলে নিষ্ফল হয়। মিয়ানমার নানা টালবাহানা এবং অযৌক্তিক কথা বলে তার অবস্থানে অনড় থাকে। সফর শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনেকটা হতাশার সুরেই বলেছেন, মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ না বাড়ালে সে কিছুই করবে না। অন্যদিকে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্যাতনকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর বিভিন্ন বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে আলোচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান অং হ্লাইংকে ফোন করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের কথা বলেন।
অং সান সুচি যে রাখাইন সফর করেছেন, বলা যায়, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে এক প্রকার বাধ্য হয়েই করেছেন। শিঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করবে। রেক্স টিলারসন আগামী সপ্তাহে মিয়ানমার সফরে যাবেন। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর রিফিউজি (প্রটেকশন) ভলকার তুর্ক মিয়ানমারে দুই দিনের সফর শেষ করেছেন। আন্তর্জাতিক এসব নানামুখী চাপের কারণেই মূলত সু চি রাখাইন সফরে গিয়েছেন। সেখানে মুসলমান নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে যা বলেছেন, তাতে প্রতীয়মাণ হয় রাখাইনে নাগরিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এটাও তার এক ধরনের কৌশলী বক্তব্য। এটা সকলেই জানেন, রাখাইনে শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন চালানো হয়েছে এবং তা চালিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জঙ্গীরা। এটি সেখানে নাগরিকদের পরস্পরের মধ্যে কোনো সংঘাত ঘটছে না। কোনো নাগরিক সংঘর্ষ নয়। তারপরও রাখাইনে সু চির সফরকে কূটনীতিবিদরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কারণ ২০১২ ও ২০১৬ সালে রাখাইনে সহিংসতা হলেও তিনি সেখানে যাননি, এবার গিয়েছেন। তবে তিনি যদি আরও আগে সফরে যেতেন হয়তো পরিস্থিতির এতো অবনতি ঘটতো না। সু চি মিয়ানমারের শীর্ষ নেত্রী, নির্বাচিত নেত্রী। জনগণের মধ্যে তার এখনো জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাদের ভেতর প্রভাব বিস্তারকারী সক্ষমতা তারই সবচেয়ে বেশি। তিনি আন্তরিক, সহৃদয় ও নাগরিক সমতার ব্যাপারে দৃঢ় হলে বিদ্যমান পরিস্থিতির সহজেই পরিবর্তন হতে পারে। তার পক্ষেই ঘৃণা-বিদ্বেষের সংস্কৃতির বদলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভবপর। মিয়ানমারের জাতীয় স্বার্থেই তিনি সেটা করবেন বলে আমরা আশা করি। যে সুচনা তিনি করেছেন, আমরা তার সাফল্য কামনা করি।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন