দিন দিন বাড়ছে মাদকের বিস্তার। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে অভিনব কৌশলে পরিবহন করা হচ্ছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার মাদক। ফলে দেশের সর্বত্রই এখন ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এ সুযোগে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মাদকের চালান অবাদে আনা-নেয়া করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। যদিও ইয়াবার চালানসহ অনেক মাদক উদ্ধার ও জড়িতরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। সূত্র জানায়, মাদক বহন করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছে দিতে মাদক ব্যবসায়ীরা নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। একটি কৌশল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জেনে গেলে তারা নতুন আরও একটি কৌশল অবলম্বন করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে ইয়াবা ও ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের চালান পৌঁছে দেয়া যায় সে বিষয় নিয়ে বেশি মনোযোগী মাদক ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন সময় জুতা, টুপি, কাঠাল, তরমুজ, বেগুন, মাছের পেটে, মরিচ, ফুল, পিয়াজ, কংক্রিটের পিলার, অ্যাম্বুলেন্স ও শরীরের বিশেষ অঙ্গসহ নানা কৌশলে মাদক বহন করেও ধরা পড়েছে অনেকেই। এছাড়া ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন সেট, দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কিংবা গ্যাস সিলিন্ডারের ভিতরে পাচার হচ্ছে মাদক। তবে বহনকারীরা ধরা পড়লেও এর মূল হোতারা থাকছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।এক্ষেত্রে ইয়াবা ও বিভিন্ন মাদক বহনকারীদের যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল নম্বর দেয়া হয়া। কাকে বা কোথায় চালানটি পৌঁছে দেয়া হবে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য জানানো হতো না বহনকারী।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব মো: জামাল উদ্দিন আহমেদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অভিনব কায়দায় মাদক পরিবহনের বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। এ জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরে মাদকের চাহিদা রয়েছে। আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে মাদকের চাহিদা কমিয়ে আনার জন্য নানা ধরনের প্রচারণামূলক কাজ করছি। এ জন্য সকলকে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া সীমান্ত দিয়ে যাতে মাদক প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে জন্যও সক্রিয় রয়েছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৪ জুন দিনগত রাত ২ টায় রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে এক যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশি করে আমের মধ্যে লুকানো এক হাজার ৮শ’ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। চট্টগ্রাম থেকে আসা ওই যাত্রীর নাম মোস্তফা কামাল আপন (৩৫)। ওই চালান আটকের কিছু দিন পর ২২ জুন সকালে কেকের ভেতরে থাকা ২ হাজার পিস ইয়াবার এক চালানসহ আব্দুল মান্নান নামের (৩৮) এক যাত্রীকে গ্রেফতার করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে আসামি আব্দুল মান্নান জানায়, তিনি প্রায় সময় টেকনাফ ও চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে ঢাকায় আসেন। রাজধানীতে তা খুচরা বিক্রি করেন। র্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, মাদক নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় হওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীর কৌশলী হয়ে উঠেছেন। গ্রেফতার এড়াতে তারা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছেন। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মাদক জব্দের পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। ওই বছরে মাদক আইনে মোট মামলা হয়েছে ৭১,৭০০টি, এতে আসামি করা হয়েছে প্রায় ১ লাখ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও কোস্টগার্ড জব্দ করেছে ২,৯৪,৫০,১৭৮ পিস ইয়াবা ও ৪,৭১,০৪,৬৫৫ কেজি গাঁজা। নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মঈনুল হক সাংবাদিকদের জানান, গত ১৮ জুন রোববার ভোর রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মৌচাক এলাকায় ডাচ বাংলা ব্যাংকের সামনে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী একটি পিকআপ ভ্যান আটক করে ভেতরে থাকা নুরুল ইসলাম ও আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাদের দেয়া তথ্য ও স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ওই পিকআপ ভ্যানের চেসিসের ভেতরে অভিনব কায়দায় একটি বাক্সে রাখা অবস্থায় ১ লাখ ৬৭ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করে। আটককৃতরা স্বীকার করে ইয়াবাগুলো কক্সবাজার থেকে পাচারের উদ্দেশে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১১ নভেম্বর লালমনিরহাটের আদিতমারি থানা পুলিশের একটি দল থানার মিলনবাজার এলাকার ব্রিজে অবস্থান নেয়। এই সময় একটি মোটর চালিত ভ্যানযোগে আটটি কংক্রিটের পিলার সহ ভ্যানচালক ভ্যান নিয়ে যাবার সময় পুলিশ তাঁকে থামিয়ে তল্লশি করার সময় কংক্রিটের পিলারের আকার সন্দেহ হলে পুলিশ চ্যালেঞ্জ করে। পরে উপস্থিত এলাকার জনসাধারণের সামনে উক্ত কংক্রিটের পিলার ভাঙার পর প্লাস্টিকের পাইপের ভেতর লুকানো বিশেষ কায়দায় সাজানো ১৫০বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করা হয়। উক্ত মাদক জব্দ করে ভ্যানচালক আব্বাস আলী(৩০) নামে একজনকে আসামী করে ১৯৭৪সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ ( বি ) ১(খ)ধারা মতে মামলা দ্বায়ের করা হয়। গত ১০ নভেম্বর রাজধানীতে সাইরেন বাজিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়া ৯৫ কেজি গাঁজাভর্তি একটি অ্যাম্বুলেন্স আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। সহকারী পুলিশ কমিশনার খন্দকার রবিউল আরাফাত লেনিন বলেন, সন্ধ্যার দিকে কাঁচপুর সেতু দিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স রাজধানীতে প্রবেশ করে। পথে গোয়েন্দা পুলিশ থামার সংকেত দিলে অ্যাম্বুলেন্সটি সাইরেন বাজিয়ে দ্রুত চলে যায়। এরপর গোয়েন্দারা তাদের অনুসরণ করে। কিন্তু পথে তাদের এক পর্যায়ে তাদের হারিয়েও ফেলে। পরে আবার অনুসন্ধান চালিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি মোহাম্মদপুর এলাকায় যাওয়ার কথা জানা যায়। অবশেষে অ্যাম্বুলেন্সটি টিক্কাপাড়া পানির পাম্পের কাছে গেলে আটক করা হয়। তিনি আরও বলেন, আটক করা অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। ভেতরে ৬টি বস্তায় ৯৫ কেজি গাঁজা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা এসব গাঁজা সীমান্ত এলাকা থেকে এনেছে। তিনি আরও বলেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটিতে সাইরেন বাজিয়ে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসে তারা। ফলে মুমূর্ষু রোগী আছে ভেবে কেউ আর পথে থামায় না, অন্যদিকে তাদেরকে সেতুতে টোলও দিতে হয় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন