বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

দুর্নীতি দমনে রাসূল সা.-এর কর্মসূচি

প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মনজুর হোসেন খান

॥ শেষ কিস্তি ॥
ফলে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকে এ দেশের প্রায় সকল সরকারের ক্ষেত্রেই কম-বেশী দুর্নীতির অভিযোগ উচ্চারিত হয়েছে। প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রশাসনিক দুর্নীতির অভিযোগ কোন নতুন ঘটনা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপে বর্তমানে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে ওঠে। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতি বছর যে অপচয় হয় তা হচ্ছে ১১,২৫৬ কোটি টাকা। ফলে সকল স্তরে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে এবং উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ চীন ও ভারতের চেয়ে প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাচ্ছে। ২০১১ সালে এউচ তে বিনিয়োগের অবদান মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ। অউই-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর তেরেসাখো বলেন, ডঊঋ-এর ২০১১-১২ রিপোর্টে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অবকাঠামোর দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ দুর্নীতি।
আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায়, সারা পৃথিবীকেই দুর্নীতি গ্রাস করে ফেলেছে। কিন্তু নীতি বহির্ভূত সকল প্রকার কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহার ও কথা-বার্তা সবই এর আওতাভূক্ত। যেহেতু আয়-উপার্জন জীবনের বিশাল অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে যৌক্তিক কারণেই বড় করে দেখা হয়। দুর্নীতি ব্যাপক বিস্তৃত একটি পরিভাষা। নীতি হিসেবে আমরা যদি ইসলামকে বেছে নেই তবে দুর্নীতিরও একটি সংজ্ঞা প্রয়োজন। ইসলামে সংজ্ঞা যদি এই হয়, ‘আল্লাহর বিধান ও দীনের সামনে আত্মসমর্পণ’ অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা, দ্বারা আল্লাহ সকল বিধানের পরিপূর্ণতা ঘটিয়েছেন সেগুলো মনে প্রাণে মেনে নেয়া। যিনি মেনে নিবেন তার মধ্যে কতগুলো গুণ-বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হবে; যথা: তিনি নীতিবান হবেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সদা তৎপর থাকবেন, তার মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ পাবে ইত্যাদি। বিপরীত দিকে ইসলামী শরীয়তে অপরাধ (জারীমা) বলেও একটি পরিভাষা রয়েছে। দুর্নীতি একটি অপরাধ। যে সম্পর্কে আল্লাহ হদ্দ (বিধিবদ্ধ শাস্তি) অথবা তাজীর (দ-বিধি) দ্বারা হুমকি প্রদান করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তির হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।”
মানুষের ইচ্ছা শক্তির দ্বারা সংঘটিত নৈতিক কর্মসমূহের বিপরীতে দুনিয়া ও পরকালে পুরস্কৃত করা হবে এবং অনৈতিক বা পাপাচারের পরিণামে শাস্তি প্রদান করা হবে। মানুষের ইচ্ছা শক্তি হচ্ছে বিনিময়ের মাপকাঠি। ইচ্ছাশক্তি যখন অপরাধ কাজের অবয়বে প্রকাশিত হয়, তখন সেটাই দুর্নীতি এবং সেটাই দ-যোগ্য। এ অপরাধ মানুষের মধ্যে মন্দ চর্চার দ্বারা বিকশিত হয়। মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা চারটি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। তা হলো-প্রভুত্বের গুণাবলী, শয়তানী গুণাবলী, পশুত্বের গুণাবলী ও হিংস্রতার গুণাবলী। প্রভুত্বের গুণাবলী দুশ্চরিত্রের উন্মেষ ঘটায়। যেমন: অহংকার, গর্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, প্রশংসা ও গৌরবের মোহ, বিরোধিতা ও চিরস্থায়ীত্বের মোহ, সবার উপরে বড়ত্বের অনুসন্ধান ইত্যাদি। এগুলো মানব চরিত্র বিধ্বংসী গুণ। এগুলোই দুর্নীতির জন্ম দেয়। শয়তানী গুণাবলী থেকেও অংসখ্য শাখা-প্রশাখা জন্ম পক্ষান্তরে এ দু’জন যদি বিকৃত স্বভাব ও কুরুচিপূর্ণ মনের অধিকারী হন এবং আধুনিক ও প্রগতিবাদী সাজার অভিপ্রায় নিয়ে উচ্ছৃংখল আচার-আচরণ, কথা-বার্তা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিসরে চালু করেন, তবে তাদের পরিবারটি নৈতিকতা বিবর্জিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে শ্রদ্ধাবোধ, লজ্জা-শরম, স্নেহমমতা ও ভালোবাসার পরিবর্তে বেয়াদবি, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও উচ্ছৃংখলতা ব্যাপকহারে চালু হবে। আমাদের সমাজে উচ্ছৃংখল কিছু পিতা-মাতা এমনও রয়েছেন যে, নিজেদের কোমলমতি ও নিষ্পাপ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একই সাথে দেশী-বিদেশী টিভি পর্দায় নর্তক-নর্তকীদের অলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ নাচ, অশ্লীল অঙ্গভক্তি ও বিকৃত যৌনাচারমূলক দৃশ্য তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করেন। একটি শিশু দুশ্চরিত্র হিসাবে গড়ে ওঠার জন্য যতগুলো উপকরণ প্রয়োজন সবগুলোর যোগান এ পিতা-মাতাই দিয়ে থাকে। আবাদুল্লাহ ইবনে আমির (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ স. বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ। বর্ণনাকারী বলেন, নবী (সা.) অশ্লীলভাষীও ছিলেন না এবং অশ্লীলতার ভানও করতেন না।’’ নবী (সা.) বলেন, ‘‘প্রত্যেক সন্তানই ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বা খ্রিস্টান বানায় অথবা অগ্নি-উপাসক বানায়।’’
পিতামাতাই যদি নিজ হাতে নিজের সন্তানদেরকে ধ্বংসের পথে তুলে দেন তবে সে সমস্ত পিতা-মাতাকে মূলত: দেশ ও জাতির শত্রু বলেই আখ্যায়িত করা যায়। কারণ অপরিণামদর্শী এসব পিতা-মাতাই জাতীয় দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, গডফাদার, আন্তর্জাতিক চোরাচালানী, চোর-ডাকাত বানাবার সবগুলো উপাদান চেতন বা অবচেতনে পারিবারিক পরিবেশে ছোট কচি মনের শিশুটির জন্য প্রধান যোগানদাতার ভূমিকা পালন করেন। তাই সকল পিতামাতার উচিত নিজের প্রাণপ্রিয় শিশুটিকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামী অনুশাসনের পূর্ণ অনুসারী হিসাবে গড়ে তোলার নিমিত্তে পারিবারিক পরিবেশে আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূলুল্লাহ (সা.) প্রদর্শিত পন্থায় সুস্থ বিনোদন ব্যবস্থা চালু করা। দুর্নীতি একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর উন্নয়নশীল অনেক দেশেই এটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। শক্তির অপব্যবহার এবং অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে বাড়ছে মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর এ কারণেই স্বচ্ছতা, আল্লাহভীতি ও জবাবদিহিতামূলক সংস্কৃতি গড়ে ওঠছে না। সৃষ্টির আদিকাল থেকে দুর্নীতি বন্ধের জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু কার্যত কোন কৌশলই ফলপ্রসূ হয়নি। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ আরো বহুবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ ফল অর্জিত হয়নি। তবে কিভাবে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা যাবে সেটা এখন বিশ্বব্যাপী একটি জিজ্ঞাসা।
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে বাংলাদেশে দুর্নীতির মত দুষ্টক্ষত সামাজিক ও জাতীয় জীবনের উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য সবাইকে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, ইসলামপ্রিয় বাংলাদেশী জনসাধারণ এর অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত দেখতে চায়। এ জন্য সমাজের তথা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতার যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। পরকালে এর ভয়াবহ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ছড়িয়ে পড়েছে তার করাল গ্রাস থেকে আমরা কেউই রেহাই পাব না। দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা যায় কিন্তু শান্তি অর্জন করা যায় না। অপরাধ আর অশান্তি একটা আরেকটার সাথে উৎপ্রোতভাবে জড়িত। যারা ন্যায়নীতি মেনে চলে তাদের অন্তরে শান্তি বিরাজমান থাকে। দুনিয়াতে অপরাধের শাস্তি হোক বা না হোক আখিরাতে সব অপরাধের বিচার হবে। তখন অন্যায়ভাবে উপার্জিত সম্পদ কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। তবে যারা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অন্তর পবিত্র করেছেন, অপরাধ ছেড়ে দিয়ে সৎভাবে জীবন যাপন করেছেন তারা আল্লাহর কঠিন আযাব থেকে যেমন রক্ষা পাবেন তদ্রƒপ অভাবনীয় পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হবেন। দেশের প্রতিটি নাগরিককে এ পথে পুরোপুরি ফিরে আসতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন