কম্বোডিয়া সফরের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারো তার পূর্বমুখী ক‚টনৈতিক উদ্যোগের জানান দিলেন। নমপেন সফরে সে দেশের রয়্যাল পার্টির প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নরোদম রানারিধের সাথে সাক্ষাৎ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সংযোগ বাড়ানোর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ বিষয়ে উভয় নেতার মধ্যে এক ধরনের মতৈক্য গড়ে উঠেছে এবং এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সংযোগ ও গণযোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়ে কর্মপন্থা নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে ভ‚-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের সুবিধা হচ্ছে এশিয়ার পশ্চিম এবং পূর্বদিকের দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগের সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্য অর্জনে ঢাকার কাছে আরেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সেই সাথে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর নমপেন সফর এবং এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সংযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ এমন সময়ে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করল যখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার, ভারত ও চীনের মত গুরুত্বপূর্ণ নিকট প্রতিবেশীর কাছে প্রত্যাশিত সহযোগিতা না পাওয়া বাংলাদেশের জন্য এক তিক্ত অভিজ্ঞতা। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর নমপেন সফরের মধ্য দিয়ে পূর্বদিকের এশীয় দেশগুলোর সাথে কানেক্টিভিটি ও সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনার কথা উচ্চারিত হয়েছে।
নয়া বিশ্ববাস্তবতায় এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সংযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগের সাথে বাংলাদেশ বরাবরই উৎসাহী ও সহযোগিতামূলক অবস্থান নিয়েছে। মূলত সারাবিশ্বেই আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ চলছে। বাংলাদেশ এর বাইরে থাকতে পারেনা। বিগত চারদলীয় জোট সরকার প্রথম পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি ঘোষনা করে মিয়ানমার ও চীনসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও সে উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। মহাজোট এবং বর্তমান সরকারও পূর্বমুখী ক‚টনীতি অব্যাহত রেখে অনেক সম্ভাবনার বাণী শোনালেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। এ সরকারের সময় কানেক্টিভিটির নামে যা কিছু হয়েছে তার প্রায় পুরোটাই হয়েছে ভারতের সাথে ও ভারতের স্বার্থে। আঞ্চলিক ও আন্তরাষ্ট্রীয় কানেক্টিভিটির মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কথা থাকলেও ভারতীয় ট্রানজিট তথা কানেক্টিভিটি ভারতকে বিশেষ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা এনে দিলেও বাংলাদেশের জন্য তেমন কোন লাভ হয়নি। অথচ কানেক্টিভিটির নামে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি ছাড়াও বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়ক, স্থল-নৌ বন্দর ও অবকাঠামো ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের বুক চিরে যাওয়া ট্রানজিট রুট দিয়ে ভারতের মূল ভ‚খন্ড থেকে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে নামমাত্র মাশুলে পণ্য পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এ অঞ্চলে পণ্য রফতানীর সুযোগও হারাতে বসেছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে পূর্বমুখী কানেক্টিভিটি এবং চীনের ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট ইনিশিয়েটিভের সাথে তাল মিলিয়ে পথ চলতে পারলে এতদিনে বাংলাদেশের পূর্ব-পশ্চিমে বিশাল বাণিজ্যিক সম্ভাবনাময় দুয়ার উন্মোচিত হয়ে যেত।
দীর্ঘদিনেও পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি ও কানেক্টিভিটির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর চীন-জাপান সফরের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে যে সম্ভাবনার কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল সে উদ্যোগ বাস্তবায়ণে ব্যর্থতার দায় এখন বহন করতে হচ্ছে। এরপরও গত বছর চীনা প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে এ যাবৎকালের বৃহত্তম বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহায়তার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের রোড ইনিশিয়েটিভ তথা সিল্করুটে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপ পর্যন্ত বাংলাদেশের বাণিজ্যিক আদানপ্রদান ও স্থল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করার সুযোগ এখনো বহাল রয়েছে। নমপেন সফরের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সংযোগ বাড়ানোর যে প্রত্যাশার কথা বলেছেন তা থেকে বোঝা যাচ্ছে তিনি তার পূর্বের অবস্থান থেকে সরে যাননি। তবে প্রকল্প গ্রহন ও বাস্তবায়নে সিদ্ধান্তহীনতা ও দীর্ঘসুত্রিতার কারণে অতীতে অনেক সম্ভাবনা আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদের মধ্যেই প্রস্তাবিত পূর্বমুখী কানেক্টিভিটি ও আঞ্চলিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের বাস্তবায়ন প্রত্যাশিত মাত্রায় অগ্রগতি হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এ ব্যাপারে সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন