পলাশীর পটভ‚মিকা ও পলাশী :
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব মুরশিদকুলী খাঁ ও পরবর্তী নবাবরা বহু হিন্দুকে জায়গির ও জমিদারি বন্দোবস্ত দেন, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের থেকে কেড়ে নিয়ে অন্য সম্প্রদায়কে দেন। মুরশিদকুলী খাঁ মাহমুদপুর (যশোর-নদীয়া) ও জালালপুর পরগনার কয়েকটি মুসলিম জমিদারি নাটোর জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা রামজীবনকে দেন। ঈসা খাঁর বংশধরের কয়েকটি মূল্যবান পরগনা যেমন আলেপশাহী ও মোমেনশাহী পরগনা কেড়ে নিয়ে দু’জন হিন্দু রাজস্ব কর্মচারীকে বন্দোবস্ত প্রদান করেন মুরশিদকুলী। নাটোর, দিঘাপাতিয়া, মুক্তাগাছা, মোমেনশাহী প্রভৃতি এলাকায় হিন্দুদের জমিদারি প্রতিষ্ঠিত হয়। দিনাজপুর ও বর্ধমানের হিন্দু জমিদারগণও তাদের সীমানা প্রসারিত করেন নবাবের সাহায্যে। মুরশিদকুলী তাঁর সময়ে ভ‚পথ-রায়, দর্পনারায়ণ, রঘুনন্দন, কিঙ্কর রায়, আলমচান্দ, লাহেরীমল, দিলপৎসিংহ, হাজারীমল এবং আরো কয়েকজন হিন্দুকে দেওয়ান ও অন্যান্য উচ্চপদে নিযুক্ত করেন (সূত্র : ড. এম এ রহিম)। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃ:-৩)।
মুরশিদকুলীর জামাই সুজাউদ্দীনের সময়ে আলমচান্দ, জগৎশেঠ, যশোবন্ত রায়, রাজবল্লভ, নন্দলাল এবং আরো বহু হিন্দু গুরুত্বপূর্ণ পদ পান মোহনলালকে প্রধানমন্ত্রী, জানকী রায়কে দেওয়ান এবং মানিক চান্দকে যথাক্রমে কলকাতা ও হুগলির ফৌজদার করেন তিনি।
ব্যবসায়ী জগৎশেঠ, উমিচাঁদদের প্রতিষ্ঠিত করেন নবাব আলীবর্দী খাঁ। আলীবর্দী খাঁর আমলে চিনরায়, বীরুদত্ত, কীরাতচান্দ ও উমিদ রায়কে খালসার দেওয়ানি, জানকী রায় ও রাম নারায়ণকে যথাক্রমে বিহারের দেওয়ানি এবং গভর্নরের পদ প্রদান করা হয়। রায়দুর্লভ উড়িষ্যার গভর্নর আর রাজবল্লভ জাহাঙ্গীর নগরের (ঢাকা) দেওয়ানি পদ পান। এই সময়ে শ্যামসুন্দর পদাতিক বাহিনীর বখশীর ও রাম রামসিংহ নবাবের গোয়েন্দা বাহিনী প্রধানের পদ পান। এগুলো সামরিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা মোহনলালকে প্রধানমন্ত্রী ও জানকীরায়কে দেওয়ান পদে নিয়োগ দেন। রায়দুর্লভ, রাম নারায়ণ, রাজবল্লভ ও অন্যান্য হিন্দু কর্মচারী দায়িত্বপূর্ণ পদ পান। মানিকলাল ও নন্দকুমার যথাক্রমে কলকাতা ও হুগলির ফৌজদার পদে নিয়োজিত হন। নবাব আলীবর্দীর সময় থেকেই জগৎশেঠ ও উমিচাঁদের পরিবার যথাক্রমে মুর্শিদাবাদ ও কলকাতায় অর্থনৈতিক শেঠ হন। নবাব সরকারের ব্যাঙ্কার ছিলেন জগৎশেঠ, যার বার্ষিক আয় তখনকার অর্থে ৪০ লাখ টাকা।
নবাবী আমলের শেষভাগে হিন্দু-প্রভাব নিয়ে রবার্ট ওম লেখেন, ‘প্রশাসনের সকল বিভাগে হিন্দুদের প্রভাব এত ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছিল যে, তাহাদের সাহায্য ছাড়া ও তাদের অজ্ঞাতে সরকারেরও কোনো কাজ চলতে পারত না।’ (‘মিলিটারি ট্রানজেক অব দি ব্রিটিশ নেশন ইন বেঙ্গল’, পৃ:-৫৩)।
এর ভেতর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের পরিকল্পনাকারী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল স্কটের সেক্রেটারি এফ নোবল সেন্ট জর্জ দুর্গের সিলেক্ট কমিটির কাছে ১৭৫৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর একটি গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠান, যাতে মুসলিম শাসন ধ্বংসে ইংরেজ-হিন্দু মিলিত ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা থাকে। নোবল লেখেন যে হিন্দু রাজা ও সাধারণ হিন্দুরা গোপনে তার কাছে প্রকাশ করে (মুর, মুসলমানদের) সরকার উৎখাত করতে একটা ‘রিভলুশনের মাধ্যমে যদি ইংরেজরা সাহায্য করে। নোবল বিশেষ করে ব্যবসায়ী উমিচাঁদ ও নিমু গোঁসাই নামে এক পুরোহিতের সহযোগিতার নিশ্চয়তা দেন। গোঁসাই এক হাজার লোক দিয়ে সাহায্যের ওয়াদা করেন। (এস সি হিল, ‘বেঙ্গল-ইন ১৭৫৬-১৭৫৭’, ইন্ডিয়ান রেকর্ড সিরিজ, পৃ:-৩২৬-৩২৮)।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়ের কথা উল্লেখ করে এস এস হিল লেখেন যে, ইংরেজরা ৪ জুন ১৭৫৬ নবাবের কলকাতা অভিযানের দুর্দিনে হিন্দুদের সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে তাদের পক্ষে তখন নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় থাকত না। (‘বেঙ্গল-ইন ১৭৫৬-৫৭, পৃ:-১৫৯)।
ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ ২৩ মার্চ ১৭৫৭ ফরাসি ব্যবসা কুঠি চন্দর নগর আক্রমণ করেন। নবাবের হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সেনাধ্যক্ষ রায়দুর্লভ ও মানিক চান্দ ইংরেজদের বাধাই দেন নাই। স্কেফটন লেখেন, ইংরেজরা তাদের ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক ব্যবসায়ী উমিচাঁদের মাধ্যমে নন্দকুমারকে দেড় হাজার টাকা ঘুষ দেয়। নন্দকুমার নবাবের গোপন সামরিক তথ্যও ইংরেজদের দেয়। (ব্রিজেন কে গুপ্ত, ‘সিরাজউদ্দৌলা অ্যান্ড দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পৃ:-১০৬)।
১৭৫৭ সালে ১৯ মে জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন বৈঠক হয়, যাতে জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ রাজবল্লভ ও মীর জাফরও উপস্থিত ছিলেন। কেম্পানির পক্ষে অ্যাডমিরাল ওয়াটস মহিলার মতো পর্দা-ঘেরা পালকিতে চরে জগৎশেঠের বাড়ির এ বৈঠকে উপস্থিত হন। সবাই চুক্তিতে সই করেন, তবে মীর জাফর সই করেন ৪ জুন। (এস সি হিল, ‘বেঙ্গল-ইন ১৭৫৬-৫৭’, পৃ:-১৫৯)।
কুমুদনাথ মল্লিকের ‘নদীয়া কাহিনী’ (সম্পাদনা বিলু কবীর, বইপত্র, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৯১) থেকে জানা যায়, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাতের অন্যতম নায়ক ছিলেন নদীয়ার সামন্ত-রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এতে উল্লেখ আছে যে, জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন ষড়যন্ত্র বৈঠকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই প্রস্তাব করেন মীর জাফরকে নবাব করতে, আর সবাইকে আশ্বস্ত করেন যে, ইংরেজদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক আছে। কালিঘাটে দেবীর পূজার ছলে কলকাতায় গিয়ে তিনি ষড়যন্ত্র পাকাপাকি করেন। এইভাবে ধীরে ধীরে পলাশীর প্রহসনের যুদ্ধ এগিয়ে আসে। সিরাজ পরাজিত ও পরবর্তীতে নিহত হলেন। মীর জাফর পুতুল নবাব হলেন। পরবর্তীতে মীর কাসেম, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে হিন্দু আমলাদের কারণে ব্যর্থ হলেন।
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বর্ণ হিন্দুদের বিশ্বাসঘাতকতা :
নবাব মীর কাসেম রাজত্ব হারিয়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাহ ও মুগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেন। কিন্তু সুজাউদ্দৌলাহর মন্ত্রী বেনী বাহাদুর ও বলওয়ান সিং (বেনারসের সামন্তরাজা) ইংরেজদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে মিলিত হন। এ ষড়যন্ত্রের কারণে মীর কাসেম ও সুজাউদ্দৌলাহর সম্মিলিত বাহিনী ১৭৬৪ সালের এপ্রিল মাসে এক যুদ্ধে পরাজিত হয়।
দ্বৈত শাসন :
হিমাংশু কর লেখেন, ‘১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিওয়ানি (অর্থনৈতিক) ক্ষমতা লাভ করে। চুক্তি অনুযায়ী, এই ক্ষমতার বিনিময়ে কোম্পানিকে দিল্লির মুঘল সম্রাটকে বছরে ২৬ লাখ ও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবকে বছরে ৫৩ লাখ টাকা দিতে হবে। রাজ্য থেকে যে রাজস্ব উঠবে তা নিয়ন্ত্রণ করবে কোম্পানি। কিন্তু এই রাজস্ব কোম্পানিকে তুলে দেবে নবাবের কর্মচারীরা। আর শাসন ক্ষমতা থাকতে নবাবের হাতে। ফলে নবাবেরা হয়ে গেল হাতের পুতুল। অর্থ বিভাগ কোম্পানির হাতে থাকায় নবাবরা ইংরেজদের কথা মানতে বাধ্য থাকত। কোম্পানির এই চাল নবাবরা ধরতে পারেনি। ব্যবস্থাটা সত্যিই আজব আর ইংরেজদের কূটকৌশল ও প্রশংসা করার মতো। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় একদিকে নবাবদের শাসন চলে, আবার অর্থসম্পদ সব কোম্পানির হাতে থাকায় কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে থাকে আসল ক্ষমতা।’ (‘বাঙালি জাতি বাঙলা ভাষা ও বাংলাদেশের উদ্ভব’, পৃ:-৬২-৬৩)।
এই ধরনের দ্বৈতশাসনের ফলে ইংরেজ ষড়যন্ত্রে অর্থাভাবে নবাবের সেনাবাহিনী দিন দিন ছোট হতে লাগল, আর খাজনা আদায়ের ইংরেজদের কালেকটরি অফিস হয়ে গেল প্রকৃত জেলা প্রশাসকের অফিস।
১৮১৩ সালে সিলেক্ট কমিটির সামনে স্যার জন ম্যালকমেরও ও ক্যাপ্টেন টি মাকানের উক্তি গুরুত্ব বহন করে। তারা যথাক্রমে বলেন, ‘আমাদের প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের অনুরক্তি আমাদের ভারত সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার প্রধান উৎস।’ ‘মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অধিকতর বিশ্বস্ত।’ (এস এ রহিম, ‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস,’ পৃ:-৫৮)।
বাংলার ইতিহাসে জাতিগত দ্ব›দ্ব :
কিশোরগঞ্জে জন্ম পরবর্তীতে ভারতীয় নীরদ কুমার চৌধুরী তার ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ বইয়ে লেখেন, ‘১৯৩৫ সালে ভারত শাসনের নতুন আইন প্রবর্তিত হইল। উহা যে হিন্দু বাঙালির মৃত্যুদÐ তাহার প্রকৃত ধারণা আজ পর্যন্তও হয় নাই।’
আসলে ১৯৩৫-এর পূর্বে নির্বাচনে ভোটার থাকত ধনীরা যারা বেশিরভাগই ধনী হিন্দু। ১৯৩৫ সালের পরে ভোটার হয় সবাইÑ ধনী-গরিব সবাই, ফলে জয়া চ্যাটার্জীর মতে তা ছিল ‘বাংলার রাজনীতিতে মফস্বলের অভ্যুদয়’ (পৃ:-৬৭), যা মূলত গ্রামীণ মুসলিম ভোটারদের অভ্যুদয় যা হিন্দুভাইদের মন:পুত ছিল না।
অধ্যাপক আহমদ শরীফ লেখেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শনে নানা লেখা বিশেষ করে বঙ্গিকচন্দ্র উচ্চারিত ‘মাতৃভাষা-মাতৃভ‚মি’ চেতনাকে ও ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীতের সম্মোহন হিন্দুজাতীয়তাকে দৃঢ়ভিত্তিক করে।’ (‘বিশ শতকে বাঙালি : বিহগদৃষ্টিতে তাদের রূপ-স্বরূপ’ পৃ:-২৩)।
বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন, ‘বাঙালিরা কখনো ইতিহাস লেখে নাই। বাঙালার কোনো ইতিহাস নাইÑ যাহা আছে, তাহা ইতিহাস নয়। বাঙালির ইতিহাস চাই, নইলে বাঙালির ভরসা নাই।’ (‘বিবিধ প্রবন্ধ, বাঙ্গালার ইতিহাস)’।
বঙ্কিম মুসলমানদের লেখা ইতিহাস, মুসলমান সুলতান নবাবদের ইতিহাস গ্রহণ করেন নাই। তবে এটা ঠিক, হিন্দুরা ইতিহাসচর্চা করত না, কিংবদন্তির উপর নির্ভর করত যা অনেক সময় দেব-দেবী সমৃদ্ধ।
১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার সভাপতি সাভার কার বলেন, ‘ভারতবর্ষকে আজ আরেক, অভিভাজ্য ও সুসংহত জাতি মনে করা যায় না। পক্ষান্তরে এ দেশে দু’টি জাতি হিন্দু ও মুসলমান।’ (এস এ মোহাইমেন, ইতিহাসের আলোকে দেশ-বিভাগ ও কায়েদে আযম জিন্নাহ’, ঢাকা, ১৯৯৪ পৃ:-১২৩)।
সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল বলেন, ‘আমরা চাই বা না চাই ভারতে দু’টি জাতি। এই সত্য মেনে নেয়া ছাড়া গতি নেই।’ (মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ‘ভারত স্বাধীন হলো’, ভারতীয় বাঙালার প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ, কলকাতা ১৯৮৯, পৃ:-১৮৩-১৮৪)।
প্রফেসর ড. জয়া চ্যাটার্জি লেখেন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে কলকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত সভায় (হিন্দু) ভদ্রলোক সমাজের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যোগদান করেন। সেখানে একজন বক্তার সুপারিশের সাথে দ্বি-জাতিতত্তে¡¡র তাত্তি¡¡কদের অনেক মিল আছে; (তিনি বলেন) হিন্দু ও মুসলমানের পৃথক সাংস্কৃতিক সংশ্লিষ্টতা, তাদের শিক্ষা, ব্যক্তিগত আইন (পারসোনাল ল’) এবং অনুরূপ বিষয়ের প্রেক্ষিতে তাদেরকে পৃথক জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং অত:পর তার কোনোরকম মতভেদ ছাড়াই অল-বেঙ্গল ফেডারেশন অ্যাসেম্বলিতে একসাথে সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও ভ্রাতৃত্বের শর্তে যোগ দিতে পারে। এ ধরনের যুক্তরাষ্ট্রীয় ধারণাই বাঙলার জন্য উপযোগী হতে পারে।’ ‘বাঙলা ভাগ হলো’, পৃ:-২৯। রাদা কুমুদ মুখার্জীর বক্তৃতা। জয়া চ্যাটার্জী লেখেন, ফুটনোটে; ‘মুখার্জীর উত্থাপিত বাঙলায় হিন্দু ও মুসলিম দুই জাতির যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বিষয়টির সঙ্গে এবং এক দশকের মধ্যে জিন্নাহ যে পাকিস্তানের দাবি তোলেন তার একটি নিশ্চিত সাজুয্য লক্ষ্য করা যায়।’ পৃ:-৫৬। এসব তথ্য প্রমাণ করে বর্ণ হিন্দুরাই দুই জাতিতত্ত¡ প্রথম আনে, তারপর মুসলমান নেতারা। ড. জয়া সত্য প্রকাশ করেছেন। কঙ্কর সিংহ লেখেন, ‘সাধারণভাবে সব মুসলমান বাঙালিদের ধারণা, কি পশ্চিম বাংলায়, কি বাংলাদেশে, ১৯৪৭’র বঙ্গ বিভাগের জন্য দায়ী হিন্দু বাঙালিরা, মুসলমান বাঙালিরা নন, এ ধারণাও অসত্য নয়।’ (১৯৪৭’র বাংলা বিভাগ অনিবার্য ছিল, পৃষ্ঠা-১৫)।
কঙ্কর লেখেন, ‘বাংলাকে বিভক্ত করার কৃতিত্ব অবশ্যই শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর। তার যুক্তি ছিল, অখÐ ভারতে যদি হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে একসাথে থাকতে না পারে, তাহলে অখÐ বাংলায়ও হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে একসাথে থাকতে পারবে না। তিনি পাঞ্জাবের উদাহরণও তুলে ধরেছিলেন। ধর্মকে দূরে রেখে ভাষার ভিত্তিতেও জাতি গঠিত হতে পারে শ্যামা প্রসাদ তা বিশ্বাস করতে চাননি।’ (পৃ:-৯২)।
কঙ্কর লেখেন, ‘কলকাতার অমৃত বাজার পত্রিকা ১৯৪৭’র মে মাসে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থায় বাংলার জনমত যাচাই করেছিল। তারা তখন জানিয়েছিল, বাংলার সাতানব্বই শতাংশ হিন্দু বাংলা বিভাগ চান।’ (পৃ:-৯৫)।
কঙ্কর লেখেন, ‘১৯৪৭-এ ইতিহাসের অলৌকিক কারণে যদি ভারত বিভক্ত না হতো, শেষ পর্যায়ে জিন্নাহ-নেহরু একসাথে ভারতে যুক্ত সরকার গঠন করে, ব্রিটিশের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে রাজী হতো, তাহলেও বাংলাকে দুটি এ দেশে (এখন যাকে রাজ্য বলা হয়) বিভক্ত করতে হতো। সেই বিভাজনের ভৌগলিক সীমারেখা অবস্থা আলাদা হতো। এটাই ছিল তখনকার সমকালীন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। ...গত ৫০ বছরে দুই বাঙালির মানসিক দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। ইতিহাসের গতিধারাতেই তা হয়েছে। এটাই এখনকার বাস্তবতা। দুই বাঙালির সেই দূরত্ব সহজে কমে যাবে সেই ভাবনাটাও ভুল।’ (পৃ:-১১৫-১১৭)।
পূর্ব বাংলার স্বাধীকার আন্দোলন ও পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ :
তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা ও ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ছয় দফাতে এই এলাকার জন্য যে ব্যবস্থা দাবি করা হয়, তার সপক্ষে যথাক্রমে বলা হয় ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে সায়ত্তশাসন দিতে হবে,’ ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়তে হবে।’ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব অপরিসীম। কাশ্মিরি নেতারা তা করে নাই, তাই কাশ্মিরের স্বাধীন হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
তমদ্দুন মজলিসের নেতা সন্দীপের মরহুম এ কে এম রফিকুল্লাহ চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘ভারত সরকার পাকিস্তান থেকে পূর্ব-পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে এ দেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায় কিনা তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যখন শেখ মুজিব এ দেশের নেতৃত্ব পুনরায় গ্রহণ করেন, তখন ভারতের ওই চেষ্টা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ তাদের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিলেও এ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর তারা কিন্তু পুরো আস্থা রাখতে পারেননি, এর প্রধান কারণ হলো যে, শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তার রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ ভক্ত। আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি ভারতীয় নেতারা ছিলেন নানা কারণে নাখোশ।’ (ভারত বিভক্তি ও বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা, পৃ:-৪০)।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন