\এক\
গ্রামে মানুষ খানাখন্দ দেখে পথচলার কথা ভাবেন। শহরে মানুষ ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার সময় কোনো ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা আছে কি-না তা দেখে পথ চলেন। খানাখন্দ আছে কি-না, ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা আছে কি-না তা সূর্যের আলোয় দিনের বেলায় একটু খেয়াল রাখলেই দেখা যায়। রাতে পথে হাঁটতে হলে আলো জ্বেলে পথে চলতে হয়। এভাবেও আমরা উপলব্ধি করি যে, পথে চলতে আলোর প্রয়োজন হয়। জ্ঞান সত্যিকার অর্থেই মানুষের জীবনে পথে চলার সেই আলো। এই আলোর অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করতে নেই। আলস্যে, উদাসীন্যে, নির্লিপ্ততায় এই আলো থেকে বঞ্চিত হতেও নেই। এতে ক্ষতি হয়। ইসলামে এবং আইনে আত্মহত্যার অধিকার যেমন কোনো মানুষের নেই; অনুরূপভাবে ঠিক তেমনি অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থাকার অধিকারও কোনো মানুষের থাকে না। কেননা, অজ্ঞতাজনিত কারণে মানুষ নিজের ক্ষতিই কেবল করেন না, কোনো কোনো বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে মানুষ অন্যের ক্ষতিও করেন। আল্লাহর শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আল্লাহ প্রথম যে প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছিলেন তাতেও জ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ইঙ্গিত ছিল। শৈশব থেকে শুনে এসেছি, আমার আব্বা বলতেন, মূর্খ লোক যমেরও শত্রæ। জ্ঞানী লোক শত্রæ হওয়াও ভালো। আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এর সত্যতা উপলব্ধি করেছি। অজ্ঞতার কারণে মূর্খ লোক ভালো ভালো করতে গিয়েও কখনো কখনো ক্ষতি করে ফেলে!
ইসলাম কোনো অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম নয়। দুনিয়াদারীর জীবনে, ব্যবহারিক জীবনেও ইসলামী জীবন বিধান অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য। প্রতিটি মানুষেরই কর্তব্য! কেননা, ইসলাম তো কেবল মুসলমানের জন্য আসেনি। সাম্য, সুবিচার, সহানুভ‚তিপূর্ণ ব্যবহার ইনসাফ সহাবস্থানমূলক আচরণ ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চল নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষেরই পাওনা হয়। মানুষ মানুষের মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন ব্যবহার থেকে উৎসাহিত হয়, অনুপ্রাণিত হয়, উপকৃত হয়। কোনো লোকের যান্ত্রিক ধর্মাচরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয় না।
হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, খ্রিস্টান হোক কিংবা ইহুদি হোক অথবা অন্য যে কোনো ধর্মাবলম্বী হোক, মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ যে কোনো মানুষকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি, স্মরণ করি। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী এরকম কিছু মানুষের পরিচয় আমি পেয়েছি। অন্য কোনো ধর্মীয় সমাজের মানুষকে প্রতিপক্ষ ও শত্রæ হিসেবে দেখে জাতীয়তাবাদী হওয়ার লোক যেসব ধর্মীয় সমাজে আছে, সেসব ধর্মীয় সমাজেও সবাই যে জাতীয়তাবাদী হন এমনটাও নয়। এটা স্মরণ রাখা দরকার।
\দুই\
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ভারতীয় উপমহাদেশের আমাদের প্রতিবেশী বড় সমাজপ্রধান স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বৈদ্যুতিক গণমাধ্যম ‘তারা বাংলায়’ ইতিহাস বিষয়ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দেখানোর একটা খুব ভালো অনুষ্ঠান হতো। আমি খুব আগ্রহ দিয়ে এই অনুষ্ঠান দেখতাম। ওরা নবাবদের আমলের মুর্শিদাবাদও দেখিয়েছিলেন। আমি মুসলমান ঘরের সন্তান। এরকম অনুষ্ঠান আমাকে খুব স্পর্শ করে। ইতিহাস আমার কাছে অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়।
ওরা মুর্শিদাবাদের কথা বলতে গিয়ে একসময় বললেন যে, মীর জাফর আলী খাঁ নিজে আলাদা নামাজ পড়ার জন্য একটা মসজিদ তৈরি করেছিলেন। ওরা আমাদের প্রতিবেশী সমাজের মানুষ হলেও একটা প্রশ্ন উচ্চারণ করলেন যে, নামাজ পড়ার সময় কী বলতেন আল্লাহর কাছে মীর জাফর আলী খাঁ?
মীর জাফর আলী খাঁর ছবি আমরা দেখেছি। দাড়ি ছিল। টুপির বিকল্প হিসেবে পাগড়ি ছিল। নামাজ পড়তেন। কিন্তু তিনি কি মুসলমান ছিলেন? মানুষ ছিলেন? এ প্রশ্ন কেবল মুসলমানদের নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের আমাদের প্রতিবেশী বড় সমাজেরও অনেকের।
অসূয়াপ্রবণতা, লোভ, অহমিকা, অপরিণামদর্শিতা মানুষকে অন্ধ করে। অজ্ঞতাও মানুষকে অন্ধ করে রাখে। পড়াশোনা করে আমি যেটা উপলব্ধি করছি সেটা এই যে, মীর জাফর আলী খাঁ অন্যতম বিশ্বাসঘাতক ছিলেন ঠিকই। তিনি বিশ্বাসঘাকতা না করলে বা তিনি বিশ্বাসঘাকতায় শেষ পর্যন্ত শরীক না হলে অন্য বিশ্বাসঘাতকরা তেমন কিছু যে করে উঠতে পারতেন না, এটাও ঠিক। তবে আমার মনে হয় যে, তিনি মূলত মূর্খ ছিলেন। তার অহমিকা, অসূয়াপ্রবণতা, অপরিণামদর্শিতা, উচ্চাকাক্সক্ষা লোভ ইত্যাদি যা কিছুই থাকুক না কেন, তার সবচেয়ে বড় পরিচয় এই ছিল যে, তিনি ছিলেন মূর্খ। কেবল মূর্খ নন। হর্দ মূর্খ।
\তিন\
ক্ষমতালিস্পা যে মানুষকে কতখানি কাÐজ্ঞানহীন, অপরিণামদর্শি ও অন্ধ বানায় সেটার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৭৫৭ সালের ১ মে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়মের সিনেট কমিটি প্রণীত এবং ৪ জুন ১৭৫৭ তারিখে নবাব পরিবারের নিকটাত্মীয় এবং নবাবের সেনাবাহিনীর বকশী মীর জাফর আলী খানের দস্তখতযুক্ত ফার্সিতে লেখা চুক্তিপত্র। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন জাতীয়তাবাদী খ্রিস্টান বণিকদের সঙ্গে মুসলমান ঘরের একজন নামাজি সন্তান হয়েও যে ১১ দফা শর্ত মেনে নিয়ে অপরিণামদর্শী কাÐজ্ঞানহীন ও মূর্খ মীর জাফর আলী খাঁ তার আত্মীয় নবাব পরিবারের সঙ্গে ভারতীয় উপ-মহাদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের সঙ্গে এবং সামগ্রিকভাবে তামাম ভারতীয় উপমহাদেশের গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন সেই শর্তগুলো ছিল :
১। ফরাসিদিগকে বাংলা দেশ হইতে তাড়াইতে হইবে।
২। সিরাজউদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের ফলে কোম্পানির ও কলকাতার অধিবাসীদের যাহা ক্ষতি হইয়াছিল, তাহা পূরণ করিতে হইবে। ইহার জন্য কোম্পানিকে এক কোটি, ইংরেজ অধিবাসীদিগকে ৫০ লক্ষ ও অন্যান্য অধিবাসীদিগকে ২৭ লক্ষ টাকা দিতে হইবে।
৩। সিরাজউদ্দৌলার সহিত সন্ধির সব শর্ত এবং পূর্বেকার নবাবদের ফরমানে ইংরেজ বণিতদিগকে যে সমুদয় সুবিধা দেওয়া হইয়াছিল, তাহা বলবৎ থাকিবে।
৪। কলকাতার সীমানা ৬০০ গজ বাড়ানো হইবে এবং এই বৃহত্তর কলকাতার অধিবাসীরা সর্ব বিষয়ে কোম্পানির শাসনাধীন হইবে। কলকাতা হইতে দক্ষিণে হুলগি পর্যন্ত ভ‚খÐে ইংরেজ জমিদার-স্বত্ব লাভ করিবে।
৫। ঢাকা ও কাশিমবাজারের কুঠি ইংরেজ কোম্পানি ইচ্ছামতো সুদৃঢ় করিতে এবং সেখানে যত খুশি সৈন্য রাখিতে পারিবে।
৬। সুবে বাংলাকে ফরাসি এবং অন্যান্য শত্রæদের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য কোম্পানি উপযুক্ত সংখ্যক সৈন্য নিযুক্ত করিবে এবং তাহার ব্যয় নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত জমি কোম্পানিকে দিতে হইবে।
৭। কোম্পানির সৈন্য নবাবকে সাহায্য করিবে। যুদ্ধের অতিরিক্ত ব্যয়ভার নবাব দিতে বাধ্য থাকিবে।
৮। কোম্পানির একজন দূত নবাবের দরবারে থাকিবেন, তিনি যখনই প্রয়োজন বোধ করিবেন নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে পারিবেন এবং তাহাকে যথোচিত সম্মান দেখাইতে হইবে।
৯। ইংরেজদের মিত্র এ শত্রæকে নবাবের মিত্র ও শত্রæ বলিয়া পরিগণিত করিতে হইবে।
১০। হুগলির দক্ষিণে গঙ্গার নিকটে নবাব কোনো নূতন দুর্গ নির্মাণ করিতে পারিবেন না।
১১। মীর জাফর যদি উপরোক্ত শর্তগুলো পালন করিতে স্বীকৃত হন, তবে ইংরেজরা তাহাকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার পদে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করিবে।
চুক্তির শর্তগুলোর এই উদ্ধৃতি পেশ করলাম ১১৯ লেনিন সরণী, কলকাতা ৭০০০১৩, এই ঠিকানাস্থিত জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে মার্চ ১৯৯৮-এ প্রকাশিত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলা দেশের ইতিহাস/মধ্যযুগ’-এর পঞ্চম সংস্করণের ২০০৫-এ প্রকাশিত পরিমার্জিত সংস্করণের ১১৯ এবং ১২০ পৃষ্ঠা থেকে।
এই দাসত্বের চুক্তির কথা যখনই মনে পড়ে খুবই কষ্ট হয়। ভাবি, এরকম দাসখত দিয়েও কেউ কেউ ঘোষিত পুতুল নবাব হয়ে মসনদে বসার খায়েশ পোষণ করে।
মীর জাফর আলী খাঁকে মূর্খ বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেছি। আমি নিশ্চিত যে, কথাটা আদৌ মিথ্যা নয়। সে সাক্ষ্য চুক্তির উল্লিখিত শর্তগুলোর মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই আছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, ক্ষমতালিপ্সা থাকলে কেউ কেউ গÐ মূর্খের মতো কাজ করে অজস্র মানুষের জীবনে অনেক শতাব্দীর জন্য কিংবা চিরকালের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনে। এমন দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় সমাজহীন মুসলমানগণ সমাজে কিছু কম নেই।
আরো অবাক হই, লোকটা নামাজ পড়তেন। এ ক্ষেত্রেও সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেল যে, ইসলাম কারো কারো কাছে স্রেফ যান্ত্রিক অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম। কিংবা হয়তো দেখানোর ব্যাপারও।
\ চার \
জ্ঞানচর্চারই একটা অংশ হিসেবে ইতিহাসচর্চার একটা অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা আছে। ১৭৫৭’র ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের আগে এই ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অবস্থা কেমন ছিল, সেটা তারিখ-তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে আলোচনা হওয়া দরকার। তেমনি ১৭৫৭’র ২৩ জুন থেকে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ১৯০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের ইতিহাস বিষয়েও ব্যাপকভাবে তারিখ-তথ্যভিত্তিক চর্চা হওয়া দরকার। তা না হলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কটা কীভাবে নষ্ট হ’লো, কীভাবে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্তে¡র জন্ম হ’লো এসব জানা যাবে না। কীভাবে ১৯৪৭-এর মধ্য-আগস্টের বিভাজনটা ঘটলো সেটাও জানা যাবে না।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলানস’ গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন :
‘বাংলার অভিজাত মুসলমান ধ্বংস হয়েছে। তাদের আয়ের পথ ছিল তিনটি, যথাÑ সৈন্য বিভাগের উঁচু পদ, দেওয়ানি ও বিচার বিভাগের পদগুলো এবং উঁচু রাজনৈতিক পদগুলোতে নিয়োগ। সৈন্য বিভাগ এখন বাংলার অভিজাত মুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাদের কেউই আমাদের সৈন্য-বাহিনীতে প্রবেশ করতে পারে না। দেওয়ানি বিভাগও তাদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। বড় বড় পদগুলো ইংরেজরা এবং ছোট ছোট পদগুলো হিন্দুরা দখল করেছে।’
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মুসলমানদের অধিকারবঞ্চিত করে যে কী রকম দুরবস্থায় ফেলেছিল সে বিষয়ে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন : ‘১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ দেওয়ানি বিভাগ থেকে মুসলিম বিতাড়ন সম্পূর্ণ করে দিয়েছে। যে সব হিন্দু রাজস্ব আদায়ের নিম্নস্তরে অবস্থান করে চাষিদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র ফলে তারা জমির মালিকানা লাভ করে জমিদার হিসেবে ধনী হয়ে উঠেছে, আর অভিজাত মুসলমান জমিদারী হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আমাদের অবিচারে এবং কর্ণওয়ালিশ কোড প্রভৃতি মারপ্যাঁচে তাদের কেউই আর এখন উঁচু রাজনৈতিক বা বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠিত নেই। অথচ এই সেদিন পর্যন্ত এই সমস্ত পদে তাদের একচেটিয়া অধিকার ছিল।’
‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন যে, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অফিস-আদালতে দু-একটা পিয়ন-চাপরাসী ছাড়া কোনো মুসলমান ছিলেন না।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক সরকারের এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের প্রতিপক্ষ ও শত্রæ সমাজ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কারণে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকারবঞ্চিত হয়ে মুসলমানরা যখন হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন, অসংগঠিত, লক্ষ্যভ্রষ্ট ও লক্ষ্যহীন, অদূরদর্শী ও অপরিণামদর্শী হয়ে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে পড়েছিলেন, সেই তখন থেকে ইংরেজদের সহযোগী সমাজের লোক হিসেবে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অধঃপতিত সমাজহীন মুসলমান সমাজের মুসলমানদের ঘৃণা করতে শিখেছেন। আড়াই হাজার বছর আগে থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যে রকম ভারতের বাইরে থেকে আসা আর্যদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর শুভ্রদের ক্ষেত্রে করে আসছেন, ঠিক সেরকমই। তবে একেশ্বরবাদী সংখ্যালঘু আর্যরা অর্থাৎ বৈদিক ব্রাহ্মণরা বহুদিন আগে থেকে পৌত্তলিক ধর্ম গ্রহণ করে শূভ্রদেরকে ইতোমধ্যে নিজেদের প্রভাববলয়ের মধ্যে রেখে মন্দির-মসজিদ প্রশ্নে, মুসলিম স্থাপত্যের প্রশ্নে, বিভিন্ন জায়গার এবং রাস্তাঘাটের মুসলিম নামের প্রশ্নে, গরু জবাই করার প্রশ্নে, তাদেরকে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্তে¡র দৃষ্টিভঙ্গিতে মুসলামনদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন এবং ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর তারিখে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙার ব্যাপারেও করসেবক হিসেবে তাদেরকে কাজে লাগানোর ব্যাপারেও সফল হয়েছেন। যদিও ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার কাজটা করা হয়েছে ডিনামাইট দিয়ে।
\ পাঁচ \
১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ প্রহসন প্রসঙ্গে ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন যে, ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খ্রিস্টান বণিকরা মোগল সাম্রাজ্যস্বরূপ ইমারত ভাঙতে চেয়েছেন, ইমারতের এক একটা স্তম্ভ ভাঙার মতো করে এক একটা সুবাহ্র পতন ঘটিয়ে।
১৭০৭-এর ৩ মার্চ আহমদাবাদে সম্রাট আওরঙ্গজেব ইন্তেকাল করার পর তাঁর লক্ষ্যভ্রষ্ট, লক্ষ্যহীন ও অপরিণামদর্শী সন্তানরা যখন সিংহাসনে বসা নিয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয়ে মোগল প্রশাসনে এবং মুসলমানদের মধ্যে ভাঙন ধরানো ব্যবস্থা করেছিলেন, সে সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের কাছে মওকা মারার একটা সুবর্ণ সুযোগ আসে।
বিভিন্ন মোগল সুবাহ্র সুবাহদাররা তখন কেন্দ্রীয় মোগল প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বাভাকিভাবে শিথিল করে প্রতিবেশী বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের লোকদের মুসলামানদের তুলনায় অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কোথাও স্বাধীন নবাব হওয়ার, কোথাও স্বাধীন সুলতান হওয়ার খায়েশ মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
সুবাহ্গুলোর মুসলিম শাসকরা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক রাখেনি। কেন্দ্রীয় মোগল প্রশাসনের সঙ্গেও সুবাহগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক তো বজায় রাখেইনি! সমাজহীন মুসলমান সমাজের ধর্মীয় নেতারাও তখন নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমিয়েছেন।
সুবাহ্ বাঙলার প্রশাসনে ভারতের বাইরের মুসলমানদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসনে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের মুসলমানদের প্রবেশও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
অন্য দিকে রাজা রাজভল্লবের মতো মোগল রাজপুরুষ কখনো সুবাহ বাঙলার বিভিন্ন এলাকার ব্রাহ্মণদের, আবার কখনো ভারতের বিভিন্ন সুবাহ্র ব্রাহ্মণদের সমাবেশের এবং সম্মেলনের ব্যবস্থা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে করছিলেন। এসব ইতিহাস গল্প-উপন্যাসের চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের সে ইতিহাসচর্চার ব্যবস্থা আমাদের স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে অপরিহার্যভাবেই করা দরকার। ইতিহাসের ঘটনাবলির তারিখ-তথ্য ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে না দেখলে শিক্ষণীয় অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। এটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথা।
লেখক : নজরুল গবেষক, ইতিহাসবিদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন