জাহানারা আরজু
জনতার রাজপথে
একটা কাক্সিক্ষত রাজপথে সুদৃঢ় পদক্ষেপ রেখে
চলে যাব, এই স্বপ্ন ছিল আজীবনÑ
তাইত সময়ের এলোমেলো বল্গাহীন ইঙ্গিতে
সমর্পিত হইনি কখনোÑ শ্রমকান্ত দুঃসময়ের
সোপানে পা রেখে ক্লান্তিহীন আমি এক পথিকÑ
হাঁটছি আর হাঁটছি।
পেয়েছি অতঃপর এক সুনির্দিষ্ট রাজপথের ঠিকানাÑ
যে পথধরে হেঁটে চলার অফুরন্ত গতি,
বলিষ্ঠ ঋজুতায় মাথা উঁচু করে হাঁটছি আর হাঁটছি।
পেছনে ফেলে এসেছি কাঁটাবন, কর্দমাক্ত ঝোপঝাঁড়Ñ
কখনো মরুর উষ্ণতায় ঝলসে গেছে অবয়বÑ
কখনো পঙ্কিল আবর্তে ডুবে ডুবে আবার উঠেছি জেগেÑ
শুভ্র এক রাজহংসের মত নিষ্কলুষ পালকে লাগেনি
মালিন্য এতটুকু, কোন হায়েনার দল আটকে রাখতে পারে নাই
গন্তব্যের নিশানা আমার!
আমিও যেন বলতে পারছি আজÑ
এই ছেঁঁড়া ছাড়া ‘রাজছত্র’ মেলে চলে গেছে এক বৈকুণ্ঠের দিকে,
আমার স্বপ্নের কুঁড়িরা যেখানে নিয়ত ফুল হয়ে ফোটে,
যেখানে আমার বরফ জমাট ব্যথার পবর্তমালা
উষ্ণ সূর্যের তাপে গলে গলে এক বহমান স্রোতস্বী হয়Ñ
যেখানে নির্ভীক মানুষের বন্ধনহীন পদধ্বনী পথ কেটে চলে
সেইÑ রাজপথে বলিষ্ঠ ঋজুতায় আমি হাঁটছি আর হাঁটছি!
নজমুল হেলাল
নদী ও দীঘি
তুমি তো বেশ নদী হয়েই ছিলে হঠাৎ কেন যে বৈরী বাতাসে
হয়ে উঠলে দীর্ঘ এক দীঘি। স্রোত নেই, গভীরতা নেই
শ্যাওলা জমে উঠছে এখন
এতে কী সাঁতার কেটে যুৎ পাবো আমিÑ
তুমিই বলো? ঢেউ ছাড়া যেন মানায় না তোমাকে!
আসলে আজব এক দুনিয়ায় বাস করি আমরা
এখানে কখনো কখনো পাল্টে যায়
নিরবধি বয়ে চলা নদীও সহসা দীর্ঘ দীঘি হয়ে যায়!!
জাহাঙ্গীর ফিরোজ
স্পার্টাকাস
আমার হাত ও কলমের মাঝে তৃতীয় পুরুষ
দাঁড়ায় হঠাৎ করে মস্তটাক
আমি সে সময় ক্রীতদাস লিখতে পারি না
প্রতিদিন পেশা-বিষয়ক জটিলতা
অনিশ্চিত বেতন, অপেক্ষা একজন কবিকেÑ
না, সে-কথাটি বলবো না,
ভুল এতে ফুল হয়ে ফুটতে পারে
ভুল যদি কষ্টের ফুল হয়
ক্ষতি নেই, ভুল যদি দুঃখ দেয় শুধু?
না কোনো কবিই-
না একথাও বলবো না,
স্পার্টাকাস, এ শতকে কোনো ক্রীতদাস নেই
সকলেই চাকরিজীবী
চাকরিজীবীদের কোনো স্পার্টাকাস সেই
চাকরিজীবীদের হাত ও কলমের মাঝে তৃতীয় পুরুষ।
যখন আমার হাত ও কলমের মাঝে কোনো তৃতীয় পুরুষ থাকে না, তখন আমি কবি।
মিজানুর রহমান তোতা
স্বাতন্ত্র সৃষ্টির উল্লাসে আচ্ছন্ন
যৌবনে নয় পৌঢ়ত্বে বিবেকতাড়িত হয়ে
প্রতিবাদ করতে হবে নীতিবিরুদ্ধ অন্যায়
অনৈতিক সবকিছুর, গর্জে উঠতে হবে
বিরোধীতাই ঐতিহ্য।
রাজনৈতিক রং ঝেড়ে পেশাদারিত্বের ঐক্যে
সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে
কুন্ঠাবোধ করা যাবে না প্রাণখুলে হাসতে হবে
এটিই হবে স্বাতন্ত্র।
নন্দিতবোধকে করতে হবে জাগ্রত সত্য ও ন্যায়ের
ঝাÐা উড়িয়ে এগুতে হবে সামনে বিস্তৃত দিগন্ত
তারাভরা আকাশ জোৎ¯œার ঢাকনি গেছে খুলে
যতœবান হতে হবে পেশার মর্যাদায়।
তা না হলে মোটেও ক্ষমা করবে না ভবিষ্যত প্রজন্ম
বলবে যৌবনে ছিল ঘরসংসার কাজকামের ব্যস্ততায়
বুদ্ধি পাকেনি সদাহাস্যে তাই সব ভুলে যাবে বিলকুল
কিন্তু ভুলবে না স্বাতন্ত্র সৃষ্টির উল্লাসে নাচা বুড়োদের
তাই এখনও সময় আছে পৌঢ়ত্বে ধাক্কা হবে যৌবনের।
মাহমুদ কামাল
মূল্য তালিকা
আমার চারপাশে দুটো চেয়ার একটি টেবিল
কিছু বই, লেখার খাতা আর কালি ও কলম
টেবিলে কাঁচের গøাস তার মাঝে আধখাওয়া পানি
অদূরে সুখের শয্যা, পরিপাটি
এসবের স্পর্শ নিয়ে আমি আছি, এগুলো আমার
জীবনের ক্ষয় মূল্যে এইসব আয়ত্ত করেছি
সম্প্রতি এইসব আমি ঠিক বিক্রি করে দেবো
প্রতিটি জিনিসের মূল্য তালিকা টানিয়ে দিয়েছি
দরোজায়, জানালায়, র্যাকে ও রাস্তায়
সমস্ত আসবাবপত্রের মূল্য মাত্র ৪২ দিন
২১ দিন লেখার খাতা ও দিন পানির গøাস
বৈদ্যুতিক পাখার মূল্য সাকুল্যে ৩৩ দিন
৩৬৫ দিন শেলফসহ সমস্ত গ্রন্থ
এবং ২৮ দিন নানাবিধ আনুষঙ্গিক
এই দামে বিক্রি হবে আমার অস্তিত্ব
কাঠামোত ঘৃণ ধরার আগেই ঠিকঠাক
হস্তান্তর হওয়া ভালো
কারণ, এসবের মালিকানা কখনো একার থাকে না।
কামরুল আলম কিরণ
লাল মেমসাহেব
আটলান্টিক তুমি বইছো এখনও ঠিক
পিএপিও ঠিক আছে দাঁড়িয়ে,
আমার স্মৃতিতে আজও তুমি শুধু তুমি
সব্বাইকে আজ ছাড়িয়ে।
হেলেনের মতো এসে হঠাৎ করে তুমি
ভেঙেছো আমার ট্রয় নগরী,
অথৈ সাগরে আমি পথহারা নাবিক
একা একা বলো কী করি।
লাল মেমসাহেব, তুমি মনরোভিয়াতে
নাকি ফিরে গেছো আংকারা, তুর্কি?
আমার জীবনটা করে দিয়ে এলোমেলো
বইয়ে দিয়ে সাইক্লোন-গোর্কি।
তোমাকে ভুলিনি হে আটলান্টিক
ভুলিনি লাল মেমসাবকে,
কেমনে ভুলি বলো মহাকাল স্বাক্ষী
জীবনের এ বড় ধাপকে।
ফাহিম ফিরোজ
লাভলীরা হয়ে যেত একেকটি কবিতা
তুমি, এখন একলা। একা তালগাছ। বহুকাল ফলহীন
বাবুইরা কেউ বাসা গাঁথতে এখানে আসে না। নির্জনতার
চূড়ামনি হয়ে আছো। এমন ছবিটা এখন আমার
চোখের ভেতর ঢোকে, বুকের ওপাশ দিয়ে নদী হয়ে যায়
দেখি, সকলেই তার পাশ-পার্শ্বহীন। বুক ফেটে যায় মোর
ছাতি ফেটে যায়। একদিন ছিলো তো সে চারপাশ নিয়ে
উচ্ছ¡ল অধীক পরীময়। এক পরী পাকঘর থেকে ছুটে এসে
তার নখ কেটে দিত, অন্যরা গুছিয়ে বাঁধতো মাথার মেঘ
ভাবীসাব, ক’বছর পর একি দেখছি ভেতরে থমথমে জলবায়ু
ডায়েনিংও মরামরা। বুকফেটে যায় রে, ছিরে রে ফুসফুস...
শিল্পে শিল্পে যুক্ত ছিলাম, যা ছিলো প্রভূত বাতিনি-তোমারই
অবদান। কই পামু...কইপামু সেই প্রামাণ্য অতীত? নাহার-কুসুম
লাভলীরা চিলেকোঠায় হয়ে যেত এক একটি কবিতা। শুনলাম
কেউ গেছেরে ধণুক ¯্রােতে, দু’একজন কোথাও কুপির
আলো হয়ে আছে। খুঁজি, সেই নানী আজ কই?
আছিলো ভেতর ঝড়ার্দ্র খুউব। তবু তারে নানী ডাকা হতো
তোমার ইঙ্গিতে। যাতে অন্ধকার ওই দিকে চোখ না ফালায়
একদিন ক্ষেপে গিয়ে কয়, আমি বুড়ি? নেড়ে দেখ, মিয়াসাবÑ
কতখানি ইউরিনিয়াম লুকিয়ে রেখেছি। বয়স্ক হয়না কেউ
চূড়ান্ত পতন না হওয়া অবধি একটি ক্ষীণ ¯্রােত বহমান সবার ভেতর।
২০/১০/২০১৭
রোকেয়া ইসলাম
তুমি যেন এক তীব্র ডাহুক
তুমি যেন একতীব্র ডাহুক, তোমার কন্ঠ শুনে ঘুম ভাঙ্গে ধীবরের
চাষীদের খোলা হাতে লাঙ্গল জোয়াল মাঝি নাও ভাসায় উঁজান গাঙ্গে
আকাশ ফুল পাখি আর সমুদ্র অথই আনন্দ
তোমার পাহারায় ধ্রুবতারা আলোকোজ্জল
তোমার ছবিটি শ্বাশত পিতার মুখ ছবি, বিশ্ব মানচিতে বাংলাদেশ গর্বিত রেখা, তোমার ধনুক হাতে বধ হবে সকল অসুর
মানব কল্যানে তোমার দিন রাত, শ্যামল দেশ সবুজে লাল পতাকা
রক্তের ঋণ বয়ে যাবে চিরদিন।
আলম শামস
জীবনের গতিপথ
প্রতিদিনের চলার পথ এত পিচ্ছিল কেন
কেন-ই বা পদে পদে থমকে যাই?
তুমি জানো কী, জানাবে কী? পথগুলো খানাখন্দে একাকার
রুদ্ধ কঙ্করময় আগামীর পথচলা, সময়ের অলিগলি
কোথাও পাইনি একটু স্বস্তি। এসবের কারণ, তুমি জানো কী?
পাকা ধানক্ষেতে শিলাবৃষ্টি ও বন্যা
গাভীন গাইয়ের হঠাৎ মৃত্যু। এসবের পরিত্রাণ কী।
ঘরে-বাইরে যাপিত জীবনে দুনিয়া ও আখেরাতে
পেতে চাই গতিময় সরল পথ তুমি বলবে কী?
চরিত্র বদল
ফরিদা হোসেন
১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাস।
ঢাকার পুরোনো এলাকা পাতলা খান লেনের একটি বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল নিমাÑ
পড়ন্ত অপরাহ্নের নরম আলো এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে।
রুক্ষ এলো খোঁপায় সোনালি ছোঁয়া লাগছে।
চারিদিকে কেমন একটা আনন্দ হিল্লোলÑ।
বাড়ির সামনের দোকানপাটের দোকানি বা মোড়ে মোড়ে অবিন্যস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাওয়ালারা আজ আর বাড়ির ছাদের দিকে দৃষ্টিপাত করছে না।
অন্যদিন হলে কোথায় কোন বাড়ির ছাদে মেয়েরা উঠেছেÑ সেদিকে ওদের চোখ থাকতÑ।
কিন্তু আজ যেন সব কিছু অন্যরকম। পুরোনো এলাকার ঘিঞ্জি গলিগুলোতেও যেন হৈ হৈ রব পড়ে গেছে।
ছোট ছোট ভ্যান জিপ আর রিকশা ভরে ভরে ফিরে আসছে যুদ্ধজয়ী মুক্তি সেনারা...। হাতে... পিঠে...কাঁধে ঝোলানো... স্টেনগান...উজ্জ্বল...প্রাণবন্ত।
রাস্তার দুধারে ছেলেবুড়োদের সেকি উল্লাস।
দুর্লভ সেই দৃশ্য...চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
নিমার কালিপড়া অসুস্থ চোখে মুখে এখন সেই বিজয় উল্লাসের ছোঁয়া...। বৈকালী সূর্যের রং এত সুন্দর ...? এত বুকে দোলা লাগানো... কই আগে তো কখনো এমন মনে হয়নি...।
নিমার পঞ্চম ইন্দ্রিয়ের প্রতিনিধিত্ব করছে যেন ওর দুটি ক্লান্ত চোখÑ।
রাস্তায় বিজয় উল্লাসের এই অভ‚তপূর্ব আনন্দ স্রোতের দৃশ্যকে যেন বুভুক্ষুর মতো গোগ্রাসে আহরণ করছেÑ।
আজ আর নিমার একবারও খেয়াল থাকলো না যে গলির মুখের রিকশাওয়ালা আর দোকানিরা ওর দিকে চেয়ে হাসছে কি-না। পাড়ার বখাটে ছেলেগুলোকেও নিমার আজ অসহ্য মনে হচ্ছে না।
ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে রাস্তায় নেমে শরিক হয় এই বিজয় মিছিলেÑ।
নিমা কতক্ষণ এই আনন্দঘোরের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল ওর খেয়াল নেই। একেবারেই ভুলে গিয়েছিল নিজের কথাÑ
নিজের অত্যাচারিত ... দংশিত ...আর দলিত জীবনের কথাÑ
হঠাৎ ওর খেয়াল হোল এই সব যুদ্ধজয়ী মুক্তিসেনাদের মতো ফিরে আসবে হাসানও। ফিরে আসবে কাঁধে অহঙ্কারী স্টেনগান নিয়ে। দুটো বলিষ্ঠ বাহু প্রসারিত করে বলবেÑ
: পরিয়ে দাও আমায় বিজয় মালা, এঁকে দাও কপালে প্রেমের চুম্বন চিহ্ন...।
হাসান যাবার সময় বলেছিল,
: যদি জয়ী হয়ে ফিরে আসি ... আমি দেখতে চাই তোমার চোখে প্রিয় বিচ্ছেদের
অধীর ব্যাকুলতা তুমি ছুটে আসবে ছাদের ঐ কোণা থেকে... তোমার চুল উড়বে
বাতাসে ... শাড়ির আঁচল লুটোবে মাটিতে...।
তোমার প্রসাধনহীন মসৃণ কপোল ভেসে যাবে আনন্দাশ্রæতে...
আর... তারই স্পর্শে ভিজে যাবে আমার ক্ষতবিক্ষত বুকের মাঝ খানটা...।
পুরোনো ঢাকার এই বাড়িটিতে ওপরে নিচে অনেক ভাড়াটে...।
দোতলার এক কোণায় ছোট্ট দুটো কামরা নিয়ে থাকে নিমা আর ওর বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা।
নিমা আর হাসানের কথা বলার জায়গা ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে...।
ছাদের নির্জনতায়...।
নিমা বিএ পড়ত সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে আর হাসান চাকরি করত একটা বেসরকারি ফার্মে। রাতে টিউশনি করত।
কথা ছিল স্বাধীনতার পর ওরা বিয়ে করবে।
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় হাসান নিমাকে বলেছিল অনেক কথা।
আর সবশেষে বলেছিলÑ
: যদি আর ফিরে না আসিÑ
: নিমা হাসানের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল,
: আর কোনো কথা নয়Ñ। তোমাকে যে ফিরে আসতেই হবেÑ।
বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে উঠলো নিমারÑ।
ফিরে আসবে হাসান...।
খবর পেয়েছে পাড়ার ছেলেদের কাছ থেকে।
নিমাকে ছাদের এই কোণায় ... এই খানটায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে প্রিয় মিলনের জন্যে।
অবিন্যস্ত এলো কেশ বাসÑ
প্রসাধনহীন মুখÑ
অশ্রæ প্লাবিত চোখ...
সব...সবই ঠিক আছে...।
একটু অন্যরকম রোমাণ্টিক স্বভাব এই হাসানের।
আর দশ জনের মতো যেন নয়...।
মাঝে মাঝে নিমা হেসে বলতÑ
: তুমি একটা চাষা। তোমার ভালোবাসা অন্য সবার মতো নয়Ñ।
হাসান বলতÑ
: মানুষটাও তো আর সবার মতো নয়।
তারপর দু’জনে একসাথে হেসে উঠতÑ।
সেই হাসানÑ।
: আর সবার চেয়ে অন্যরকম হাসান, শুধুমাত্র নিমার হাসান ফিরে আসবে বিজয়ী সৈনিকের বেশে...।
নিমার মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগল। ঝাঁপসা হয়ে এলো দুটো চোখ।
আর দাঁড়াতে পারল না রাস্তায় চোখ পেতে। অক্লান্ত কান্নায় ভেঙে পড়ল নিমাÑ।
রাস্তায় বিজয় উল্লাসের সেøাগান আর ছাদের কোণায়, নিমার অক্লান্ত কান্নার শব্দ মিশে একাকার হয়ে গেল।
এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে।
আজানের ধ্বনি দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল...।
তখনো নিমা বসে রইল ছাদের কোণায় স্থিরÑ।
অবিচলÑ।
ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল সব।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়েÑপাড়ায় তখন সাংঘাতিক গরম হাওয়া।
বাড়িঘর ছেড়ে পাড়ার প্রায় সবাই চলে গেছে অন্যত্র, নিরাপদ কোনো স্থানে। নিমাদের দালানের সব ভাড়াটেরাও চলে গেছে মাসখানেক হলো। পুরো এলাকাটাই বলতে গেলে খালিÑ।
শুধুমাত্র বাবার অসুস্থতার জন্যে কোথাও যাওয়া হয়নি নিমাদেরÑ।
এই অবস্থায় নিরূপায় হয়ে নিজ বাড়িতেই... বাবাকে নিয়ে থেকে গেল নিমাÑ।
আসন্ন বিপদের কথা অনুমান করতে পেরেও নিজেকে রক্ষা করতে পারল না সে।
পুরো পাড়াটাই খাঁ খাঁ করছে।
দু’চারটি বাড়িতে শুধু দু’একজন অথর্ব বুড়োবুড়ি রয়ে গেছে মাত্রÑ।
এরই মধ্যে একদিন রাত্রে এসে ঢুকল হানাদার বাহিনীÑ।
অনেকগুলো বুটের শব্দ নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত উঠে এলো।
তোলপাড় করে তুলল উপর-নিচ।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাৎরাচ্ছিলেন বাবা।
নিমা লুকিয়ে ছিল ছাদের এককোণায়।
এক সময় দুমদাম করতে করতে ছাদে এসে হাজির হলো শয়তানগুলোÑ।
নিমা তখন ভয়ে প্রায় সংজ্ঞাহীন।
আল্লাহ্কে ডাকবার কথা পর্যন্ত ওর তখন মনে আসেনি।
তারপর যা হবার তাই হলো।
একে একে কয়েকজনের অত্যাচারে নিমা একেবারে মৃতপ্রায়।
যখন ওর জ্ঞান হলোÑ
তখন গভীর রাত।
বাকি রাতটাও নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল ছাদে...।
আর কোনো ভয়-ডর যেন নিমার রইল না...।
অন্ধকারের রহস্যময়তাÑ
গলির মুখের কুকুরের বিলাপি কান্না... মিলিটারি ভ্যানের শব্দ... অথবা রাস্তায় বুটের শব্দ...।
আর কোনো ভয়ের ভাবনা নেই নিমার। নরপশুদের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত একটি কুমারী মেয়ের নতুন করে ভয় পাওয়ার আর কি-ই বা আছে ...?
নিমা যেন কাঁদতেও ভুলে গেছে...।
পরদিন সকালে নিজেকে স্বাভাবিক চেহারায় এনে বাবার মুখোমুখি হতে খুবই কষ্ট হলো ওরÑ।
বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন-
: হানাদাররা যখন বাড়িতে ঢুকেছিলÑতুই তখন লুকিয়ে ছিলি তো মা ?
নিমা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললÑ
: হ্যাঁ বাবাÑ।
: খুব ভালো করেছিস। আমি তো অসুস্থতার জন্য বড় বাঁচা বেঁচে গেছিÑ।
নইলে যে কি হতো।
নিমা একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে চেষ্টা করলÑ অসুস্থ বাবা জানতেও পারল না গত রাতের ঘটনার কথা।
এরপর প্রায় একমাসের ওপর হয়ে গেছে। অসুস্থ বাবার জন্য নিজেকে নিয়ে আর কিছু ভাবার সময় পায়নি নিমা।
কনকনে শীতে বাবার শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে। প্রতি মুহূর্তেই যাই যাই করছেন।
নিমা শুধু দিন গুনতে থাকেÑ।
কবে হবে যুদ্ধের শেষ...?
কবে আসবে স্বাধীনতা...?
কবে আসবে হাসান ...?
আর কবে হাসানের বুকে মুখ লুকিয়ে আকুল হয়ে একটু কাঁদতে পারবে নিমা ?
খবর আসছে চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরছে দলে দলেÑ।
নিমার প্রতীক্ষার প্রহর যেন আর কাটতে চায় নাÑ।
কিভাবে দাঁড়াবে নিমা ঐ যুদ্ধজয়ী সৈনিকের সামনে...?
কিভাবে চোখে চোখ রেখে কথা বলবে...?
হাসানের সামনে নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করবে নিমা...?
যে বিষাক্ত ছোবল প্রতি নিয়ত দংশন করছে ওর দেহ মনে Ñ।
নিমা ভাবতে পারে নাÑ।
জানেনা এর পরিণাম কি হবে...?
কিভাবে ওকে গ্রহণ করবে হাসান Ñ?
বাবা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেনÑ
: হাসান কবে ফিরবে বলতে পারিসÑ?
বাবার কথায় নিমার বুকের ভেতরটায় যেন কেমন করে ওঠেÑ।
বলেÑ
: সময় হলেই ফিরবে বাবা।
বাবা আবার বলেন-
: আচ্ছা কি সাংঘাতিক কাÐ বল তো ?
: কি বাবা ?
: এই যে আমাদের ছেলেপুলেরা মিলে দেশটাকে স্বাধীন করে ফেলল। ভাবতে কেমন অবাক লাগেÑ। আসলে আমাদের ছেলেরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। না-কি বলিস...?
নিমা দেখল দেশপ্রেম আর গর্বিত উত্তেজনায় যেন একটু উঠে বসতে চেষ্টা করেছেনÑবাবাÑ।
চোখে মুখে দারুণ আবেগের ছোঁয়া...।
নিমা বাবাকে আবার শুইয়ে দিল পরম যতেœ।
একটু হাসবার মতো মুখ করে বললÑ
: তুমি ঠিকই বলেছ বাবা...।
নিজের ঘরে যাচ্ছিল নিমা।
বাবা আবার ডাকলেনÑ।
নিমা ফিরে দাঁড়ালÑ।
বাবা বললেনÑ
: আচ্ছা হাসান এত দেরি করছে কেন...?
ওর কাছে যে আমার অনেক কিছু জানার ছিলÑ।
অসুস্থ না হলে আমিও নিশ্চয় যুদ্ধে ওদের সঙ্গী হতাম। না কি বলিস ?
: হ্যাঁ বাবা।
: আমার জন্য তোরও কোথাও যাওয়া হলো না। ভাগ্যিস তোর কোনো ক্ষতি হয়নিÑ
নিমা জানলায় চোখ পেতে রইল অনিমেষ। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন কুকড়ে কুকড়ে ব্যথা করতে লাগল...।
কোনো কথা বলল না।
বাইরে বৈকালী রোদের ঝিলিমিলি।
লোকজনের কোলাহল।
বø্যাঙ্ক ফায়ারের আনন্দ ধ্বনিÑ।
এরই মধ্যে একদিন দলবল নিয়ে ফিরে এলো হাসান।
প্রচুর হৈ চৈÑ
শোরগোল ওদের উপস্থিতিতেÑ।
নিমা কিছু বুঝতে পারার আগেই ওপরে উঠে এলো হাসান।
নিমার আর নিচে নামা হলো না।
সিঁড়ির মুখেই ওকে দু’বাহু বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলো হাসানÑ।
নিমা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না।
স্বপ্ন নয় তোÑ
নিমার কাঁন্নার কথা ছিল।
কিন্তু তাও ভুলে গেল ঘটনার আকস্মিকতায়।
একসময় ওরা দু’জন বাবার ঘরে এসে দাঁড়াল। বাবা শুয়েছিলেন। উঠে বসতে চেষ্টা করলেন কাত হয়ে...।
বললেনÑ
: তুমি আমার সামনে এসে বস হাসান। তোমাকে একটু দেখি। তোমাদের দেখলেও পুণ্যিÑ। যুদ্ধ করেছো। দেশ স্বাধীন করেছ। বাংলার এক একটা রতœ তোমরা...সত্যি কি আনন্দ!
বসলো হাসান।
কাঁধ থেকে একটা ব্যাগ নামিয়ে রাখল খাটের এক পাশে। নিমাকে বললÑ
: নাও এটা একটু সাবধানে রাখো। সব তোমার জন্যে।
নিমা বললÑ
: সে না হয় রাখব।
তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একটু বোস। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি।
হাসান চট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বললÑ
: না না খাবার টাবারের কোনো দরকার নেই। বড্ড তাড়া আছেÑ। পরে আবার আসব।
নিমা বললÑ
: কতদিন পরে এলে। এখনি যাবে ?
হাসান বললÑ
: হ্যাঁ এখনি। নাও ব্যাগটা তুলে রাখো।
নিমা একটু চুপ করে থেকে বললÑ
: কি আছে এতে ?
হাসানের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসিতে।
বলল Ñ
: সাত রাজার ধন ।
নিমা অবাক হলো।
: মানেÑ?
: দেখতে চাওÑ?
হাসান এবার ব্যাগের মুখটা খুলে উপুড় করে ঢালল বিছানায়।
ছড়িয়ে পড়ল অনেকগুলো সোনা আর হীরের গহনাÑ।
নিমা আতঙ্কিত হয়ে তাকাল হাসানের দিকে।
বললÑ
: তুমিতো যুদ্ধে গিয়েছিলেÑ!
হ্যাঁÑ
: তাহলে এগুলোÑ?
হাসান দৃঢ় কণ্ঠে বললÑ
: এগুলো যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার।
: যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার...! সরকার দিয়েছে তোমাকে...?
হাসান গয়নাগুলো ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বললÑ
: সরকার দেবে কেনÑ। আমি মানে আমরা নিয়েছিÑ।
: মানে Ñ!
: মানে যেখানে যত উর্দুওয়ালা ছিল সে সব শেঠদের বাড়িতে আমরা রেট করে
এগুলো পেয়েছিÑ।
নিমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো থর থর করে...।
কম্পিত কণ্ঠে বললÑ
: লুট করেছ...?
হাসান বলল Ñ
: তা কেন,সবাই তাই করছেÑ।
এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না বাবা। অসুস্থ কম্পিত কণ্ঠে গর্জন করে উঠলেনÑ
: সবাই নয়Ñ তোমার মতো চরিত্রের দু’একজন করছে।
হাসান ব্যাপারটাকে সহজ করবার জন্য হাসল একটু। বললÑ
: এতে রাগবার কি হলো চাচা। আমরা যুদ্ধ করে দেশ শত্রæমুক্ত করেছি।
এসবের ওপর আমাদের হক আছে।
: না নেইÑ। নিরীহ মানুষের আমানতের ওপর অন্যের হক থাকতে পারে না। নিমা এতক্ষণ দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল শক্ত হয়ে...।
ও যেন নিজের চোখ কানকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না-যে
এই সেই হাসান।
হাসান তাকাল নিমার দিকেÑ।
বললÑ।
: প্লিজ নিমা চাচাকে বোঝাও।
নিমা প্রতিউত্তরে সমস্ত ঘৃণা ছুঁড়ে মারল ওর দৃষ্টিতে।
বললÑ
: তুমি লুট করেছ...! ডাকাতি করেছ, ছি: হাসান ... ছি:...।
: ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল নিমা, প্লিজ, টেক ইট ইজি। নাও ব্যাগটা রাখো।
পরে কথা হবে। আজ চলিÑ।
বলে সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে যাচ্ছিল হাসান।
: দাঁড়াও।
ডাকল নিমা।
এতদিন ওর মধ্যে যে আত্মগøানি বা অপরাধবোধ ওকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, সেই অনুভ‚তি যেন এক মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল হাসানের অপরাধের কাছেÑ।
হাসান ফিরে তাকালÑ।
: কিছু বলবে?
: নাÑ
: তাহলে পিছু ডাকলে যে ?
নিমা দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিল অনেক কষ্টে।
তারপর ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল। এটা নিয়ে যাওÑ।
: কেন ?
পাপ রাখার জন্যে-এ ঘর নয়।
: নিমা।
হাসান যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
বুঝতে পারছে নাÑ একি রূপ নিমার...? একি শক্তি...?
একি সেই লাস্যময়ী প্রেমিকা নিমা?
হাসান হাসবার মতো মুখ করেÑদু’ধাপ এগিয়ে আসতে গেল ওপরে।
বললÑ
: নিমা প্লিজ-ল²ীটি আমাকে ভুল বুঝো না।
হাসানের আর ওপরে আসা হলো না।
গয়নাভর্তি ব্যাগটা ছুড়ে মারল নিমা হাসানের দিকেÑ।
সমস্ত চোখে মুখে প্রচÐ ঘৃণা ছুড়ে বললÑ
: ছি:
তারপর তরতরিয়ে ওপরে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলো দড়াম করেÑ।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল হাসান।
বারবার অনুরোধ করল নিমাকে দরজা খোলার জন্য।
কিন্তু দরজা নিমা খোলেনি।
হাসানের একটা কথাও কানে যায়নি ওর। বিস্ময়ে ঘেন্নায় মাথাটা ওর কেমন ঝিমঝিম করছিলÑ।
কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে দেশের জন্য যে মানুষ জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছে, সেই মানুষ আত্মসুখের জন্যে অন্যের আমানত...?
এই কি একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র...?
বাবার কোলের কাছে লুটিয়ে পড়ল নিমা, হাসান কেন এমন হয়ে গেল বাবা... কি দরকার ছিল এসব করার...?
বাবা কোনো কথা বলতে পারলেন না। ক্ষতবিক্ষত নিমার অবিন্যন্ত চুলে হাত বুলাতে লাগলেন শুধুÑ।
নিমা একসময় বললÑ
: তুমি ঠিকই বলেছিলে বাবাÑসত্যি এমন কোনো কাজ নেই যা আমাদের ছেলেরা পারে না।
বাবা এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন নাÑ।
ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলেনÑ।
বাইরে তখন প্রচÐ শোরগোলে আতশবাজি আর বø্যাঙ্ক ফায়ারের আনন্দধ্বনিÑ।
নিমা দু’হাতে কান চেপে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন