শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিজয় দিবস সংখ্যা

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নমূলক কথা

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্র্রতীক | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আমি নিজে যুদ্ধ করেছি আমার সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এবং তাঁর উপরস্থ অধিনায়ক ছিলেন প্র্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। শেষের চার মাস আমি যুদ্ধ করেছি আমার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে। আমার ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছিলেন (ব্রিগেড সমতুল্য) এস ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ এবং তাঁর উপরস্থ কর্তৃপক্ষ ছিলেন প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উল্লেখ্য, যুদ্ধকালীন মেজর কে এম সফিউল্লাহ বা লেফটেনেন্ট কর্নেল সফিউল্লাহ হচ্ছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীরউত্তম। এস ফোর্স সংগঠিত করার অল্প কয়েকদিন আগে জেড ফোর্স এবং অল্প কয়েকদিন পরে কে ফোর্স সংগঠিত করা হয়েছিল। জেড ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন যুদ্ধকালীন লেফটেনেন্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান তথা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম তথা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সকল সেক্টর ও ফোর্স কমান্ডারের প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। তবে সর্বাত্মক সম্মান পাবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি অন্তত এক দশকের পরিশ্রমের দ্বারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে প্রস্তুত করেছিলেন স্বাধীকার বা স্বাধীনতার জন্য; অত:পর বিশেষ সম্মান পাবেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের ১ নম্বর সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান, যার কণ্ঠ থেকে নি:সৃত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথমে নিজের নামে এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নামে।
১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয় দিবস এলেই মুক্তিযুদ্ধের বিগত ৯ মাসের স্মৃতি ভেসে ওঠে। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে লক্ষ কোটি শব্দে এবং অন্তরের অন্তস্থল থেকে অসীম ব্যাপকতায় শুকরিয়া জ্ঞাপন করি যে, তিনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছিলেন এবং অন্তরকে মুক্তিযুদ্ধমুখী করেছিলেন; তাই আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে, কোটি কোটি মুক্তিযোদ্ধার একজন। ১৯৭২ সাল থেকে নিয়ে আজ অবধি কমপক্ষে পাঁচবার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বা সরকারের অনুমতিতে অন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাগণের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশের পূর্বে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে বলে জানানো হতো। প্রত্যেকবারই মুক্তিযোদ্ধাগণের সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে তথা কম বা বেশি হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে সকল বাঙালি সদস্য বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তাদের নামের তালিকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে আছে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও বাংলাদেশ নৌবাহিনী সদর দফতরদ্বয়ে, মুক্তিযোদ্ধা বিমান ও নৌ-সেনাদের বা অফিসারদের তালিকা আছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে সকল ব্যাটালিয়ন মুক্তিযুদ্ধে কেন্দ্রীয় ভ‚মিকা পালন করে, তাদের সংগে যোগ দেয়া মুক্তিযোদ্ধাগণের তালিকা নিয়েও বিশেষ ঝামেলা নেই। ঝামেলা অন্যত্র তথা : দলীয় রাজনৈতিক কারণে তালিকাভুক্ত হওয়ার, বা তালিকাভুক্ত করানো, বা তালিকা থেকে বাদ দেয়ার প্রবণতা, অথবা মুক্তিযোদ্ধাগণের পারস্পরিক বৈরী সম্পর্কের কারণে কেউ কাউকে বাদ দেয়ার প্রবণতা, অথবা কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ভুলক্রমে বাদ যাওয়ায় সেই নামটিকে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টাকালে রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত বাধার সৃষ্টি ইত্যাদি। অভিযোগ আছে যে, কোনোরকমেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, বা এমনকি পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, এমন প্রচুর সংখ্যক ব্যক্তিও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, তৎকালীন (১৯৭২) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের স্বাক্ষর করা সনদপ্রত্র সংগ্রহ করেন অথবা মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর স্বাক্ষর করা সনদপত্র সংগ্রহ করেন, যে কোনো নীতিবহির্ভুত পন্থায়। ১৯৭২-এর অস্থিতিশীল রাজনৈতিক-প্রশাসনিক পরিবেশে এ কাজটি ঘটে যায়। তাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণের সংখ্যা উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একাধিক রূপের উদাহরণ উপস্থাপন করছি। বর্ণনাটি দীর্ঘ। স্বাধীন বাঙলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীগণ ও তাদের পেছনে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ; অতি জনপ্রিয় ও ফলপ্রসূ অনুষ্ঠান ‘চরম পত্র’-এর উপস্থাপক বা পাঠক এম আর আখতার মুকুল; নৌকার ওই মাঝিগণ, যারা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের দিনে বা রাতে ছদ্মবেশে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পার করে দিতেন; গ্রামের মসজিদের ওই সচেতন মুয়াজ্জিন যিনি তাদেরই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে সাহস ও উৎসাহ দিতেন বা মুসল্লি পরিচয়ে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে সাময়িকভাবে মসজিদে লুকিয়ে রাখতেন; গ্রামের মন্দিরের ওই পুরোহিত যিনি আগন্তুক কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে ছদ্মবেশ ধারণে সাহায্য করেছেন; গ্রামের বা শহরের ওই মধ্যবিত্ত গৃহিণী যাকে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা খালাম্মা ডাকত অথবা চাচি ডাকত অথবা আপা ডাকত এবং যেই গৃহিণী গভীর রাতে নিজেদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে তাদের ভাত খাওয়াতো; ওই সাংবাদিকগণ যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রে অথবা বিদেশি সংবাদ সংস্থার নিকট পৌঁছে দিত; ওই স্কুলশিক্ষক যিনি দিনের বেলা পাঠদান করতেন, কিন্তু রাতের বেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়ে তথ্য আদান-প্রদান করতেন; চট্টগ্রাম বন্দরের ওই কর্মচারীগণ যারা জাহাজে করে বাংলাদেশের স্বার্থের পরিপন্থী কী আসছে সেটা মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন, পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ওই কর্মকর্তাগণ যারা পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশের জন্য দায়িত্ব পালন শুরু করেন; ওই বিশিষ্ট নাগরিকগণ বা আইনজীবীগণ বা অধ্যাপকগণ বা বিচারপতিগণ বা চিকিৎসকগণ যারা নিজ নিজ পেশায় নিয়োজিত থেকেও চতুর্দিকে জনগণের মনে ধৈর্যের পরিবেশ, সাহসের পরিবেশ, উৎসাহের পরিবেশ বজায় রাখতেন; ওই সকল মহিলা বা ছাত্রী যারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা না ভেবেই দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছে বা ভারতের মাটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে সেবা-শুশ্রæষা করেছে; ওই সকল দুরন্ত কিশোরগণ, যারা মাঠে গরু চরানোর নাম করে বা ঘাস কাটার নাম করে বা হানাদার বাহিনীর বাজার করে দেয়ার নাম করে গুপ্তচরের কাজ করত ইত্যাদি। একটি সুনির্দিষ্ট নাম উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করছি। তৎকালীন সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা তথা বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার সীমান্তবর্তী তেলিয়া পাড়া গ্রামের অন্যতম সচ্ছল গৃহস্থ ছিলেন তৎকালীন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ আলী দেওয়ান (১৯৯৫ সালে মরহুম)। তিনি তার ১২টি গরু, গোলায় মজুদ সব ধানকে চাল করে, দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাৎক্ষণিক ব্যয় করেন। আশরাফ আলী দেওয়ানের মতো আরো হাজার হাজার পরিবার আছে। সত্যের খাতিরে এটাও বলে রাখতে হবে, সুযোগ পেয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেনি এমন ব্যক্তি ও পরিবারও হাজার হাজার আছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি বাঙালি প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম থেকে নিয়ে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত, মুক্তিযোদ্ধারাই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের ব্যস্ত রাখে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ভারতের মাটিতে। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে করে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে এটা সত্য, তবে শুধুমাত্র ঐরূপ অস্ত্র দিয়েই সর্বাঙ্গীন যুদ্ধ পরিচালিত হয়নি। বিশেষত বিভিন্ন সেক্টরে এবং ফোর্সগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাক, অস্ত্র, যানবাহন ইত্যাদি সরবরাহ করে ভারত সরকার। ওই সহযোগিতার জন্য আমরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে, ভারতের নিজস্ব কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্বার্থ অবশ্যই জড়িত ছিল যেগুলো এখানে আজকের কলাম আলোচনা করছি না, শুধুমাত্র স্থানের অভাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে পাকিস্তান বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করার নিমিত্তেই, ভারত প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা শুরু করে। যদি ভারত প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করত তাহলে মুক্তিযুদ্ধ কতদিন চলত, এর উপকার এবং অপকার কী হতো এই ধরনের প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে গেলেও দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন; যেটা আজকের কলামে করছি না।
আমি একজন সৈনিক হিসেবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দান করেছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই; যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ইজ্জত হারিয়েছেন, সম্পদ হারিয়েছেন তাঁদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি প্রাণ দান করেছেন। এই ৩০ লাখ শহীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা। দুই লাখ বাঙালি মা-বোন তাদের ইজ্জত হারিয়েছেন হানাদার বাহিনী ও তাদের সঙ্গীদের হাতে, তাঁদেরকে শ্রদ্ধা জানাই। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি ভাটিয়ারিতে, ১৯৯৪-৯৫ সালে আমি (তথা আমার নেতৃত্বে তৎকালীন অফিসার স¤প্রদায় ও সুবেদার মেজর কামাল উদ্দিনসহ সকলের সহযোগিতায়) যেই ভাস্কর্য নির্মাণ করেছি (নাম : স্বাধীনতা মানচিত্র) সেখানে সাতটি স্তম্ভ প্রতীকীভাবেই সাতজন বীর শ্রেষ্ঠের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং সাতজন বীর শ্রেষ্ঠ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে যে সকল ভারতীয় সৈনিক বাঙলার মাটিতে রক্ত দান করেছে, সেই সকল সহযোদ্ধাকে অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর চার হাজার ৬১ জন অফিসার, জেসিও, সৈনিক যুদ্ধাহত হয়েছিলেন এবং এক হাজার ৫২৫ জন অফিসার, জেসিও, সৈনিক নিহত হয়েছেন। অপরপক্ষে পাকিস্তানিগণের পক্ষ থেকে যারা সারেন্ডার বা আত্মসমর্পণ করেছিলেন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ তাদের মোট সংখ্যা হচ্ছে ৯১ হাজার, ৫৬ হাজার ৬৯৪ জন সামরিক ব্যক্তি, ১২ হাজার ১৯২ জন আধা-সামরিক ব্যক্তি ও বাকিরা বেসামরিক ব্যক্তি। ভারতের ক্ষয়ক্ষতি ও পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের তথ্যগুলো বিগত বছরগুলোতে প্রকাশিত অনেক বইয়ে, অনেক ম্যাগাজিনে, অনেক পত্রিকার কলামে ভিন্ন ভিন্নভাবে তথা কম-বেশিভাবে দেয়া আছে; তবে আজকে এই কলামের এই অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত তথ্যগুলো আমি নিয়েছি যেই গ্রন্থ থেকে সেটির নাম : ‘ইন্ডিয়ান আর্মি আফটার ইন্ডিপেন্ডেন্স’: লেখক মেজর কে সি প্রভাল, প্রকাশক লান্সার ইন্টারন্যাশনাল, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৭ সাল।
আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধকালে সহায়তা করার জন্য আমরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ, কিন্তু কৃতজ্ঞতার সীমারেখা অনালোচিত এবং অচিহ্নিত হওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নামে বাংলাদেশের স্বার্থহানী করা হচ্ছে। এর সংশোধন প্রয়োজন। বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী হচ্ছে ভারত রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সীমান্তের পঁচানব্বই ভাগ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে এবং মাত্র পাঁচ ভাগ হচ্ছে বার্মা বা মিয়ানমারের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ছিল অতি উষ্ণ, ভারতের উপর নির্ভরশীল কিন্তু বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার ভারসাম্য রক্ষার প্রধান উপাত্ত ছিলেন। মোশতাক, সায়েম ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সালের মে পর্যন্ত ছিল উষ্ণতা বহাল রেখে আনুষ্ঠানিক সম্মানজনক সম্পর্ক সৃষ্টির প্রয়াস। জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সম্পর্ক প্রকাশ্যে ছিল না অতি উষ্ণ না অতি শীতল; অপ্রকাশ্যে ভারতের উপর ক্ষীণভাবে নির্ভরশীল। খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ছিল ভারতের প্রতি শীতল বন্ধুত্বের সময়। শেখ হাসিনার আমলে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ছিল অতীতের উষ্ণ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের কাল। খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আমলে ২০০১ থেকে ২০০৬ ছিল ভারতের প্রতি শীতল বন্ধুত্ব ও ভারত নির্ভরতা কমিয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে দৃষ্টি প্রশস্ত করার সময়। ওয়ান ইলেভেন সৃষ্ট তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ থেকে ২০০৮ ছিল নাতিশীতোষ্ণ কিন্তু অপ্রকাশ্যে ভারতনির্ভর বা প্রকাশ্যেই ভারতের বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় আমলে ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত পারস্পরিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক উভয়ের পক্ষ থেকে আগ্রাসী পর্যায়ের অর্থাৎ এগ্রেসিভ ফ্রেন্ডশিপ। ২০১৭ সালের আগস্টের পরে রোহিঙ্গা সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে এবং এই সঙ্কটের কারণেই ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের দ্ব›দ্ব উপস্থাপিত হয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট না হলে কোনোদিনই জানতাম না যে, ভারত আমাদের বিপদের দিনে পাশে থাকবে না। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে ভারতের কী স্বার্থ কাজ করে থাকতে পারে, বা কী স্বার্থ কাজ করেছিল সেটা অবশ্যই আলোচনার বিষয়। একান্তভাবে ভারত বিরোধীরা বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা একরকম দৃষ্টিতে আলোচনা করেন। একান্তভাবে ভারত অনুসারীরা আরেক রকম দৃষ্টিতে আলোচনা করেন। এই নিবন্ধ শেষ করার আগে শুধু এতটুকুই বলতে চাই যে, বিনা স্বার্থে ভারত বাংলাদেশের মাটিকে তাদের রক্ত দিয়ে সিক্ত করেনি।
এই কলামের উপরের অংশে এক জায়গায়, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ভাটিয়ারির আঙ্গিনায়, স্বাধীনতা মানচিত্র নামক মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের কথা উল্লেখ করেছি। যদি না, কোনো বৈরী মনোভাবাপন্ন মানুষ সেই ভাস্কর্যের ক্ষতি করে, তা হলে সেই ভাস্কর্য টিকে থাকবে। এই ভাস্কর্যটি কার চিন্তাপ্রসূত বা কার আমলে বানানো হলো, এটি গৌণ তথ্য। মূখ্য তথ্য হবে, বাস্তবতা হবে যে, ভাস্কর্যটি বিদ্যমান। এই কলামের পাঠককে সপরিবারে বা সবান্ধব বা সদলবলে ওই ভাস্কর্য দেখে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। নিশ্চিতভাবে নিবেদন করতে চাই যে, সেটি আসলেই একটি ভিন্ন প্রকৃতির। সেখানে কয়েকটন ওজনের একটি পাথর আছে যেটির গায়ে একটি বাক্য উৎকীর্ণ করা আছে। সেখানে একটি বটবৃক্ষের গোড়ালি আছে, যেখানে একটি বাক্য উৎকীর্ণ করা আছে। পুরো ভাস্কর্য এলাকাটি, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অতি সুপরিচিত এক প্রকারের কাঁটাযুক্ত ক্যাকটাস যার স্থানীয় নাম ফনিমনসা, এটা দিয়ে বেড়া দেয়া। দর্শক চিন্তার খোরাক পাবেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা একটি দীর্ঘমেয়াদী কাজ। বিখ্যাত কবিতার দুইটি চরণ হলো : ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।’ তদ্রæপ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকগণের বক্তব্য, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের সৈনিকগণের বক্তব্য, মুক্তিযুদ্ধের পর্যবেক্ষকগণের বক্তব্য, মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকগণের বক্তব্য ইত্যাদি লিখিত হতেই থাকবে, ক্রমান্বয়ে আকার এবং আকৃতি বৃদ্ধি হবে এবং এর মধ্য দিয়েই প্রকৃত গবেষক ও ইতিহাসবিদগণের জন্য চিন্তার খোরাক রেডি হতে থাকবে। আমরা যারা এখনো জীবিত, আমরা বর্ণনা করতে পারব। বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বছরে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনাভিত্তিক বা উপলব্ধি ভিত্তিক অনেক পুস্তক রচিত হয়েছে। ১৯৭২ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত না হলেও অন্তত ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যতগুলো বই বের হয়েছে, এর কোনো হালনাগাদ ক্যাটালগ কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু এরূপ একটি ক্যাটালগ প্রয়োজন। যখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি ভাটিয়ারিতে কমান্ড্যান্ট ছিলাম, তখন ওই একাডেমির ডাইরেক্টর অফ স্টাডিজ তথা শিক্ষা বিভাগের প্রধান ছিলেন বর্তমানে মরহুম তৎকালীন কর্নেল শফিকউল্লাহ বীর প্রতীক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে শফিকউল্লাহ ছিলেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের বাংলার প্রভাষক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে, তিনি রণাঙ্গণের যুদ্ধে যোগ দেন এবং কমিশন পান। পরবর্তীতে তিনি আর্মি এডুকেশন কোরে পদোন্নতি পেতে পেতে কর্নেল হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-অন্তপ্রাণ, যেমন বীরত্বের প্রতীক, তেমনই সততার প্রতীক, তেমনই ন্যায্যতার প্রতীক। আমি তাঁকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও অন্যান্য বড় বড় শহরে পাঠিয়েছিলাম গবেষণা করার জন্য, খোঁজ নেয়ার জন্য, তদন্ত করার জন্য, যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী কী বই প্রকাশ হয়েছে? তিনি অনেকগুলো বই সংগ্রহ করে এনেছিলেন। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি লাইব্রেরিতে একটা আলাদা কর্নার স্থাপন করি যেখানে শুধু মুক্তিযুদ্ধের বইগুলো রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। ভাটিয়ারি থেকে ট্রান্সফার হয়ে এবং পদোন্নতি পেয়ে আমি যোগদান করি যশোরের জিওসি হিসেবে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে। সেখানেও লাইব্রেরিতে একই কাজ করি। এতটুকু কথা বলে রাখার উদ্দেশ্য হলো, আগামী প্রজন্মের জন্য কাজটিকে সহজ করা।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন