বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশস্ত রাজপথ নির্মাণে ইসলামের প্রভাব যে প্রকটভাবে কাজ করেছে তা সকলেরই জানা। ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজা শশাঙ্ক সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েই এ দেশের অধিবাসী বৌদ্ধদের উপর যে কঠোর অত্যাচার চালান, বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিজের ব্রাহ্মণ্যবাদী চরিত্রের মুখোশ যে খুলে দেন, তাও ইতিহাসে লেখা আছে।
এমনকি এই নিষ্ঠুর রাজা শশাঙ্ক নিজের গাত্রদাহ মেটানোর জন্য অহিংসবাদী বৌদ্ধদের পূত বৃক্ষ বুদ্ধ গয়ার বোধিদ্রæম শেকড়শুদ্ধ উৎপাটন করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। হিন্দু রাজার এই অকথ্য অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেক বৌদ্ধ পরিবার পাহাড়-জঙ্গলে এমনকি দেশান্তর হয়ে পালিয়ে যান। জানা যায়, মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মর্দে মুজাহিদের চেতনায় সমৃদ্ধ মাহাথির মুহম্মদের পূর্বপুরুষ এই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে মালয়েশিয়ায় চলে যান।
বাংলাদেশ একসময় মাৎস্যন্যায় অবস্থায় দিন অতিবাহিত করেছে, তারপর এখানকার জনগণের মিলিত চেষ্টায় গোপাল নামে এক রাজা শাসনক্ষমতায় এসেছেন। এখানে কিছুকাল বৌদ্ধ রাজত্ব প্রবহমান হলেও আবার তা কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজত্বে পরিণত হয় সেন রাজবংশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর এই সেন রাজবংশের অবসান ঘটে মুসলিম বীর সিপাহশালার ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর দ্বারা এখানে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হওয়ার মাধ্যমে। মুসলিম শাসন কায়েমের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার ঔজ্জ্বল্যে আলোকিত হওয়ার দিশা খুঁজে পেলো। সত্যিকার অর্থে পরাধীনতার নির্যাতনের নিগড় থেকে মুক্ত হলো, সেন রাজাদের জারি করা বর্ণবাদ ও কৌলিন্য প্রথার যাঁতাকল থেকে রেহাই পেলো।
সেন রাজপুরোহিতদের দ্বারা ব্যাখ্যাত যে শ্রেণিবিভাজন তাতে বলা হয়েছিল : ব্রহ্মার মস্তক হচ্ছে ব্রাহ্মণ, বাহু হচ্ছে ক্ষত্রিয়, উরু হচ্ছে বৈশ্য আর পা হচ্ছে শুদ্র। এ ছাড়া আরো অনুন্নত নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু ছিল, যারা হচ্ছেÑ হাড়ি, ডোম, চÐাল বা চাঁড়াল।
এসব নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায়কে অতি ঘৃণার চোখে দেখা হতো, এমনকি তাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মানবতা অপমানে গুমরে মরছিল, মূল্যবোধ নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছিল, স্বাধীনতা চিন্তা করাটাও যেনো উধাও হয়ে গিয়েছিল, স্বাধীনতা বলতে কোথাও কিছু ছিল না।
ইসলাম এখানে এসে মানবতার বিজয়-বারতা ঘোষণা করল। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের সূচনা হয় ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত হুদাইবিয়ার সন্ধির পর থেকেই। তবে আরব বণিকদের দ্বারা এ অঞ্চলে ইসলামের খবর ইতোপূর্বেই এসে যায়। সেসব বণিকের বাণিজ্য নৌ-জাহাজ সুদূর চীন-সূমাত্রা অঞ্চল পর্যন্ত যাতায়াত করত। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ছুঁয়ে সেসব জাহাজে দূরপ্রাচ্যে ইসলাম প্রচার করতে যেসব সাহাবায়ে কেরাম যেতেন, তাঁদের কেউ কেউ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর এলাকায় সফর বিরতি দিয়ে এখানকার মানুষের সামনে ইসলামের বাণী এবং এর সৌন্দর্য তুলে ধরতেন। তাঁরা বোধ করি বাংলাদেশের উপক‚লীয় বন্দর ছাড়া ভেতরে প্রবেশের মওকা পাননি সময়ের অভাবে। কারণ, তাঁদের গন্তব্যস্থল ছিল দূরপ্রাচ্য। তখন চীন দেশের শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য জগৎজোড়া খ্যাতি ছিল। সেসব সাহাবায়ে কেরামের মাজার শরিফ আজও চীনের ক্যান্টন নগরীর ম্যাসেঞ্জার মসজিদ প্রাঙ্গণে যতেœর সঙ্গে সংরক্ষিত আছে।
বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারের সূচনা হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ফারুকে আজম হজরত উমর রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহুর খিলাফতকাল (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.)-এর মধ্যভাগে। দলে দলে এখানে ইসলাম প্রচারক আসতে শুরু করেন। তাঁরা বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে মানুষকে তাওহিদ ও রিসালাতের প্রতি আহŸান জানান। তাঁদের মধ্যে এ দেশের মানুষ জীবনের সৌন্দর্য খুঁজে পান, তাঁদের শান্ত ও সৌম্য আচরণ তাদেরকে মুগ্ধ করে। সেসব ইসলাম প্রচারকগণ এই দেশের মানুষের ভাষাকে আয়ত্তে এনে সেই ভাষাতেই তাদের সামনে ইসলামের মর্মবাণী প্রচার করতেন। যার ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এ দেশের মানুষ এই সত্য জীবনব্যবস্থা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে ইসলামে দাখিল হতে থাকে। তারা ইসলামের বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার পথ-পরিক্রমে এগুতে থাকে। যেখানে ব্রাহ্মণ কিম্বা উচ্চ শ্রেণী ছাড়া কেউ বিদ্যা অর্জনের সুযোগ পেতো না, সেখানে ইসলাম ঘোষণা করল শিক্ষা হাসিল করা সবার জন্য অবশ্যই কর্তব্য। যেখানে বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যাওয়ার ভয় দেখানো হতো। সেখানে ইসলাম আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্যে ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্যের কথা বলল। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়া মিন আয়াতিহি খালকুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়াখলাফু আল সিনাতিকুম ওয়া আল ওয়ানিকুমÑ আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমÐলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য (সূরা রূম : আয়াত-২২)।
সুতরাং প্রত্যেকটি ভাষাই আল্লাহ জাল্লা শানুহুর দান। কারো ভাষাকে অবজ্ঞা করা মানে আল্লাহর এই দানকে অবজ্ঞা করা। মানুষে মানুষে বৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে দিয়ে বিদায় হজের ভাষণে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : সবাই আদম থেকে, আর আদম মাটি থেকে। ইসলামের এই শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষেরা কোনো মানুষের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার বিরুদ্ধে সর্বযুগে সোচ্চার হয়ে ওঠে। যে কারণে ১২০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার সাথে সাথে এখানকার মানুষ স্বাধীনতার সুবাতাস লাভ করল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলার সোনালি যুগ বলতে বুঝায়, বাংলার সেই সুলতানি যুগকেই। এই সোনালি যুগের মর্যাদা বিশ্ব পরিমÐলেও খ্যাতি লাভ করেছিল। ঢাকার সোনারগাঁয়ে শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ.) এমন এক ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন যে, সেই কেন্দ্র থেকে উচ্চ ডিগ্রি লাভের জন্য দূরপ্রাচ্য এমনকি মধ্যপ্রাচ্য থেকেও শিক্ষার্থীরা এসে ভিড় জমাতো। ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই বিশাল শিক্ষাকেন্দ্র স্বাধীন বাংলার তদানীন্তন রাজধানী সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠিত হলে এ অঞ্চলের মানুষ উচ্চশিক্ষা লাভের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে। তদানীন্তন মুসলিম জাহানেই শুধু নয়, পৃথিবীর অন্য কোথাও এত উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় আর দ্বিতীয়টি তেমন একটা ছিল না।
এখানে কুরআন-হাদীসের উচ্চশিক্ষা প্রদান ছাড়াও জাহিরি-বাতিনি তাবৎ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। ইল্ম হাদীসের সর্বোচ্চ ডিগ্রি এখান থেকে প্রদান করা হতো। তদানীন্তন মুসলিম দুনিয়ার বহু বিখ্যাত আলেম এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। বহুকক্ষবিশিষ্ট এই শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের জন্য সুরম্য আবাসন ব্যবস্থা ছিল। আবু তাওয়ামা ছিলেন এই বিশাল কেন্দ্রের মহাধ্যক্ষ। তা ছাড়াও তিনি এখানে একটি তালিমগাহও স্থাপন করেন, যেখানে তিনি ইল্ম তাসাওউফের তালিম দিতেন। এই বিশাল কর্মকাÐ আঞ্জাম দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে, এখানে স্বাধীনতার সুবাতাস প্রবাহিত ছিল। তিনি প্রথমে তাঁর জন্মভ‚মি বুখারা থেকে এসে দিল্লিতে এরকম একটা শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কারণ, দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের কোপানলে তিনি পড়েন। বাধ্য হয়ে তিনি প্রকৃত স্বাধীন দেশ বাংলায় এসে তা স্থাপন করতে সমর্থ হন। এখানে উল্লেখ্য, দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রি.) তদানীন্তন বাঙ্গালাকে নিজ অধীনে নেয়ার জন্য তাঁর পুত্র বুগরা খানকে প্রেরণ করেন। বিরাট বাহিনী নিয়ে এসে বুগরা খান এ দেশ দখল করলেন বটে, কিন্তু তিনিও দিল্লির অধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। তাঁর নাম আজো বগরা বা বগুড়া জেলা বহন করছে।
বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের ইন্তেকালের পরে সুলতানের অমাত্য দিনাজপুরের ভাতুড়িয়ার জমিদার কংশনারায়ণ গণেশ বাংলার মসনদ দখল করলে পীরে কামিল হজরত নূর কুতবুল আলম রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই অত্যাচারী রাজা গণেশকে উৎখাত করার জন্য জৌনপুরের শাসনকর্তা ইবরাহীম শরকীকে পত্র দেন। পত্রে তিনি লেখেন : প্রায় তিনশ’ বছর হয়েছে বাংলায় ইসলামের শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে, কিন্তু অতি সম্প্রতি এখানে ঈমানকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সত্য-সুন্দরের শত্রæদের কালো থাবা এ দেশটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। দেশজুড়ে আঁধার নেমে এসেছে, মুসলিমদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রæর উপর মারাত্মক আঘাত এসেছে। ইসলামের আলোক-প্রদীপ এখানকার মানুষকে যে সত্য পথের দিশা দিয়ে আসছিল, আজ তা হুমকির মুখে। এই মহা দুর্দিনে আপনি কেমন করে নির্বিঘেœ মসনদে আসীন থাকতে পারেন? আপনি আপনার ওই সুখের মসনদ থেকে উঠে আসুন। দীনকে সংরক্ষণের জন্য আপনি অতিসত্ত¡র এগিয়ে আসুন। আপনার তরবারি কোষবদ্ধ না রেখে কুফরের প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা নির্বাপণে আপনি জোরকদমে অগ্রসর হোন। আপনি তো জানেন, বাংলা হচ্ছে পৃথিবীতে বেহেশত। কিন্তু সেই বেহেশত এখন দোযখের কালো ছায়ায় ছেয়ে ফেলেছে। এখানে অত্যাচার-জুলুম-নিপীড়ন আর হত্যাকাÐের যে কাÐকারখানা চলছে, তা দমন করতে আপনি আসুন। আরামের মসনদে আর একপলকও বসে থাকবেন না।
সেই দীর্ঘ ও জ্বালাময়ী পত্র পেয়ে ইবরাহীম শরকী কোনোরুপ কালক্ষেপণ না করে বিরাট বাহিনী নিয়ে বাঙ্গালার বিপন্ন স্বাধীনতাকে বিপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে এলেন। এ খবর পেয়ে সমূহ বিপদের আশঙ্কা করে, জানে মরার ভয়ে এগিয়ে কংশনারায়ণ গণেশ হজরত নূর কুতবুল আলম রহমাতুল্লাহি আলাইহির দরবারে এসে ক্ষমা চাইল এবং তার পুত্র যদুকে মুসলিম করে নেয়ার জন্য অনুরোধ করল। হজরত নূর কুতবুল আলম (রহ.) যদুকে ইসলামে বায়’আত করলেন এবং তার নাম রাখলেন জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ্। এ খবর পেয়ে ইবরাহীম শরকী জৌনপুরে ফিরে গেলেন।
জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ ইসলামের শরিয়ত অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু আবার গণেশ ষড়যন্ত্রের আশ্রয়ে বাঙ্গালার শাসন ব্যবস্থা নিজের হাতে তুলে নিয়ে মুসলিমদের উপর অকথ্য অত্যাচার করতে থাকে, এমনকি অনেক আলেম-উলামাকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে। এই নরাধম হজরত নূর কুতবুল আলম (রহ.)-এর দুই সন্তান শায়খ আনোয়ার ও শায়খ জাহিদকে সোনারগাঁয়ে নজরবন্দী করে রাখে। শুধু তাই নয়, শায়খ আনোয়ারকে হত্যা করা হয়, কিন্তু যেদিন যেসময়ে শায়খ আনোয়ারকে হত্যা করা হয়, সেদিন সেই সময়টাতেই গণেশও মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। কারো কারো মতে, পুত্র যদু ওরফে জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ নিজ হাতে পিতা গণেশকে হত্যা করে মুসলিম নিধনের প্রতিশোধ গ্রহণ করেন এবং বাঙ্গালার তথা শাহে বাঙ্গালার স্বাধীনতার পতাকাকে সমুন্নত রাখেন।
বাঙ্গালার ৫৫৬ বছরের মুসলিম সুশাসনের মাঝখানে মাত্র তিন-চার বছরে বর্ণহিন্দু শাসন একটি দুঃস্বপ্নের মতো কিম্বা একটি ছন্দবদ্ধ সুন্দর দীর্ঘ কবিতায় একটি মাত্র পঙক্তিতে একটি মাত্রার হেরফের হওয়ার মতো সামান্য ছন্দপতনের মতো। ইতিহাসে রাজা গণেশ ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
ইসলামের শিক্ষায় উজ্জীবিত মীর কাসিম, সূফি দরবেশ ফকির মজনু শাহ, বিজ্ঞ আলেম হাজী শরিয়তুল্লাহ, মর্দে মুজাহীদ সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, জিহাদের ডাক দিয়েছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ নির্মাণ করতে করতে অগ্রসর হয়েছেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী জনতার মহা-বিপ্লবের নেতৃত্বে সূফি দরবেশ, আলেম-উলামার থাকার কথা সর্বজনবিদিত। পীর মুহসিনউদ্দীন দুদুমিয়া বন্দী হয়েছেন, তার পরের ইতিহাস নতুন কৌশলে সংগ্রামের ইতিহাস। হাজী শরিয়তুল্লাহ এ দেশকে দারুল হরব ঘোষণা করে জিহাদের যে ডাক দিয়েছিলেন, তা এ দেশের মানুষকে যে মাত্রায় স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্পৃহা জাগিয়েছিল, ঠিক একই মাত্রায় একটু কৌশলের ভিন্নতায় এনে মাওলানা কারামত আলী (রহ.) এ দেশকে দারুল আমান বা নিরাপদ ভ‚মি ঘোষণা করে মুসলিমদের স্বার্থ উদ্ধারের পথ নির্মাণ করে দিলেন। নবাব আবদুল লতিফ তাঁর দোয়া গ্রহণ করে যে শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা করলেন, তারই পথ-পরিক্রমায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম শিক্ষা-সম্মেলনে মুসলিমদের প্রথম রাজনৈতিক দল গঠিত হলো। এই সম্মেলনের আহŸায়ক ঢাকার নবাব সলীমুল্লাহ বাহাদুর ভারতের বিভিন্ন এলাকায় অ্যাজেন্ডায় বঙ্গভঙ্গ বিষয়ক আলোচনা রাখার প্রস্তাব দিয়ে পত্র পাঠালেন; যাতে বললেন যে, মুসলিমদের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন না থাকায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে যে বঙ্গভঙ্গ হয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ববাংলা প্রদেশ গঠিত হয়েছে, ঢাকা তার রাজধানী হয়েছে, তার বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক দল কংগ্রেস আন্দোলন করছে, কিন্তু আমাদের পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর অ্যাজেন্ডায় এ বিষয়টি যুক্ত করার কথা লিখে পত্র দিলেন।
সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। শত চেষ্টা করেও বঙ্গভঙ্গ রদ ঠেকানো গেলো না। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে রাজা পঞ্চম জর্জের করোনেশন উৎসবে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলো। নবাব সলীমুল্লাহ মুষড়ে পড়লেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি ইন্তেকাল করলেন।
হিন্দুদের প্রচÐ বাধার মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান অ্যাক্টে কিছুটা হলেও মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষিত হলো। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করলেন শেরেবাংলা, কিন্তু ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ এপ্রিল এই প্রস্তাবে উল্লিখিত ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহে আলাদা আলাদা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের স্থলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উল্লেখই গৃহীত হলো। প্রতিবাদ করলেন আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানী প্রমুখ। যাক, মুসলিমদের আলাদা আবাসভ‚মি পাকিস্তান কায়েম হলো বটে, কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তান মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হলো।
এ সমস্ত আন্দোলনেই প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আমরা দেখতে পাই, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকেÑ যিনি একজন পীরে কামেলও ছিলেন। সব আন্দোলনের নয়নমণিও ছিলেন।
আমরা লক্ষ্য করি, সব আন্দোলনেই ইসলামের প্রভাব সক্রিয় ছিল। মওলানা ভাসানীর ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ ফেব্রæয়ারি কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়ে আসসালামু আলাইকুম বলা, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবের ইনশাআল্লাহ বলা, ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন বলা, ২৬ মার্চ মেজর জিয়ার সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাস থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইশতেহার ও নিদের্শাবলিতে আল্লাহ আমাদের সহায়, ‘নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুনকারিব’ প্রভৃতি লিপিবদ্ধকরণের মধ্যে ইসলামের বৈপ্লবিক চেতনার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। বিশেষ করে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের এক নির্দেশাবলিমূলক ইশতেহারের শীর্ষে লেখা ছিলÑ আল্লাহু আকবার এবং শেষ করা হয়েছিল এই বলেÑ আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী। এ সমস্ত প্রেক্ষিতেই বলা যায়, দুই লক্ষ মসজিদের এই দেশ, শত শত আল্লাহর ওলির স্মৃতিধন্য এই দেশ তার স্বাধীন সত্তা মুখ্যত লাভ করেছে ইসলামের প্রভাবে।
লেখক : মুফাসসিরে কুরআন গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন