কুতুবউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ। বারো মাসে ছয়টি ঋতু এ দেশে ঘুরেফিরে আবর্তিত হয়। এ দেশটি ষড়ঋতুর রূপ-রস, সৌন্দর্য দ্বারা এতটাই প্রভাবিত যে, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয় এ দেশের প্রাকৃতিক সুষমা, পারিপার্শি¦ক বাতাবরণ, মানুষসহ অন্যান্য জীবসকলের স্বাভাবিক আচার-আচরণ, দৈনন্দিন জীবনযাপনের রীতি-বৈশিষ্ট্য, সর্বোপরি মনুষ্য সমাজের কৃষ্টি-কালচার পর্যন্ত।
সুতরাং বলা যায়, ঋতুর এ পরিবর্তন কেবল মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারারই পরিবর্তন করে না; পরিবর্তন করে এ-দেশের কবি-সাহিত্যিকদের মন-মানসিকতারও। বসন্তের ঝিরিঝিরি বাতাসে প্রকৃতির এমন এক উপাদান মিশে আছে যার সংস্পর্শে মানুষের আটপৌরে মনের বেশখানিকটা পরিবর্তন ঘটে; মনের গহিনে স্বপ্ন এসে নিরিবিলি বাসা বাঁধে। তাই বাংলা ভাষার কবিতাও এ-পরিবর্তনের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত নয়। এ-দেশের প্রতিনিধিত্বকারী কবি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মনে বসতগড়া কবিশক্তিও [প্রত্যেক মানুষের মনে একজন কবির বাস] এ-ঋতুর রূপ-রসে মোহিত হন এবং তাদের কবিতায় এ রূপ-রসের ছোঁয়ার ছাপ লক্ষ করা যায় স্পষ্টতই।
আমাদের দেশের সবচেয়ে জৌলুসময় ঋতু বসন্ত; বলা হয় ঋতুরাজ বসন্ত। রূপ-রসের ঝাঁপি নিয়ে এসে আমাদের দুয়ারে হাজির হয় ঋতুরাজ বসন্ত। বসন্তের রূপে-গুণে কেবল মানব সন্তানই নয়, বন-বনানীর বৃক্ষরাজি, নানান রঙের পাখ-পাখালিও উল্লসিত ও উদ্ভাসিত হয় দারুণভাবে। মোটকথা এ সময়টাতে প্রকৃতিতে কোনো কাঙালিপনা থাকে না; সে সাজে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। সঙ্গে এ-দেশের কবিকূলও দুই হাতে লিখে যান আপন ঢঙে, নতুন আবহে।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছে, কবিরা বসন্তের প্রভাব তুলে ধরেছেন তাদের রচিত অমর পঙ্ক্তিমালায়। এ ঋতুটাকে বাংলার কবি সম্প্রদায় জনসম্মুখে তুলে ধরেছেন বোধহয় একটু বেশি গুরুত্ব দিয়েই। মধ্যযুগের কবি বড়–চ-ীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যা বাংলা ভাষার দ্বিতীয় নিদর্শন; এই কাব্যগ্রন্থটিতেই আমরা বসন্তের প্রভাব লক্ষ করি দারুণভাবে। এ কাব্যের প্রাণভোমরা রাধা বসন্তের হৃদয়হরণ করা সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। বসন্তের এই অপার সৌন্দর্যের মাঝে প্রেমিক কৃষ্ণকে তার চাই। কৃষ্ণ ব্যতীত বসন্তের এ অপার সৌন্দর্য তার নিকট ষোলোআনাই বৃথা; এমনকি কৃষ্ণ ব্যতীত বসন্তের সৌন্দর্য যেন তার নিকট নরক যন্ত্রণার মতো। তদুপরি চারদিকে নানান পাখির গুঞ্জরণে সে আরও আকুল ও ব্যাকুল হয়ে পড়ে। তাই সে করুণ কণ্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে :
বসন্ত কালে কোকিল রাএ।
মনে মনমথ সে বাণ তাএ।।
আম্মার বোল সাবধান হয়;
বাহির চন্দ্রকিরণে সোঅ।।
কি সুতিব আম্মে চন্দ্রকিরণে।
আধিকেঁ বড়ায়ি দহে মদনে।।
[বিরহ খ- : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন]
মধ্যযুগের অন্যতম কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। বাংলা সাহিত্যে সবল চরিত্র রূপায়নে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার নির্মিত অন্যতম চরিত্র নায়িকা ফুল্লরাও বসন্তের আবেদন উপেক্ষা করতে পারেনি :
সহজে শীতল ঋতু ফাল্গুন যে মাসে।
পোড়ায় রমণীগণ বসন্ত বাতাসে।
[ফুল্লুরার বারো মাসের দুঃখ : কালকেতুর উপাখ্যান]
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তও বসন্তের আবেগে নিজেকে জড়িয়েছেন। তিনিও বসন্তের পাখ-পাখালির কলরবে মুখরিত হয়েছেন। বসন্তের রঙে নিজের অন্তরকে রাঙিয়েছেন বাংলা ভাষার এ অমর শিল্পস্রষ্টা :
নহ তুমি পিক, পাখি, বিখ্যাত ভারতে,
মাধবের বার্তাবহ; যার কুহরণে
ফোটে কোটি ফুলু পুঞ্জ মঞ্জু কুঞ্জবনে!-
তবুও সঙ্গীত-রঙ্গ করিছ যে মতে
গায়ক, পুলক তাহে জনমে এ মনে!
[বসন্তের একটি পাখির প্রতি : চতুর্দশপদী কবিতাবলী]
বাংলা ভাষার অসামান্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বসন্তে প্রভাবিত হয়েছেন। বসন্তকে বুকে ধারণ করে তিনি বসন্তের ভাষায় আবেগায়িত হয়ে কথা বলেছেন। বলা যায় তিনি বাংলার এ-ঋতুটি নিয়ে ভেবেছেন অনেক। নিজস্ব চিন্তার অনেকখানিই ব্যয় করেছেন তিনি ঋতুরাজ বসন্তকে নিয়ে। তিনি বসন্তকে জানিয়েছেন :
অযুতবৎসর আগে, হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে
মত্ত কুতুহলী
প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের দক্ষিণদুয়ার
মর্তে এলি চলি-
অকস্মাৎ দাঁড়াইলে মানবের কুটির প্রাঙ্গণে
পিতাম্বর পরি,
উতলা উত্তরী হতে উড়াইয়া উন্মাদ পবণে
মন্দার মঞ্জুরিÑ
দলে দলে নরনারী ছুটে এল গৃহদ্বার খুলি
লয়ে বীণা বেণু,
মাতিয়া পাগল নৃত্যে হাসিয়া করিল হানাহানি
ছুঁড়ি পুষ্পরেণু ।।
[বসন্ত : কল্পনা]
প্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভালোবেসেছিলেন এক নারীকে। এই বসন্তেই তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল। কিন্তু নয়ন সমুখে আর সেই নারী নেই। কবি এত দিনে প্রায় ভুলেও গিয়েছিলেন এই প্রেয়সীকে। কিন্তু বাদ সাধে আবার সেই চিরচেনা বসন্ত। প্রেয়সী চলে গেছে বিস্মৃতির অতল তলে। কিন্তু বসন্ত হানা দেয় ঠিকই কবির দুয়ারে। বসন্তের গুঞ্জরণে কবির মনে পড়ে সেই হারানো মানবীকে যার সঙ্গে বসন্তে প্রথম দেখা হয়েছিল :
বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুমরে ওঠে মন,
পেয়েছিলাম এমনি হাওয়ায় তোমার পরশন।
তেমনি আবার মহুয়া-মউ
মৌমাছিদের কৃষ্ণা-বউ
পান ক’রে ওই ঢুলছে নেশায়, দুলছে মহুল বন,
ফুল-সৌখিন দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!
[চৈতি হাওয়া : ছায়ানট]
কবি সুফিয়া কামালও বসন্তকে আহ্বান জানিয়েছেন অমর পঙ্ক্তিমালায়। তার ক্লান্ত-জীর্ণ মন বসন্তের নতুন বাতাসে নতুন করে জেগে ওঠে। তিনি আনমনা হয়ে যান। প্রকৃতির সঙ্গে তিনিও দুলে উঠেছিলেন :
কখন হয়েছে শুরু বসন্তের পুষ্প সমারোহ,
কেটে গেছে শিশিরের ব্যথাঘন কুয়াশার মোহ,
বুঝি নাই ছিলাম উন্মনা!
অকস্মাৎ দেখি শুরু হইয়াছে কী সে আনাগোনা
মধুপ অলির-
বাতায়ন পথে তারা করিয়াছে ভিড়
প্রভাতের স্বর্ণ আলো সাথে।
[বসন্তলিপি : মায়াকাজল]
বসন্তের পঙ্ক্তিমালা সৃৃষ্টি করে যে কবি সবচেয়ে অধিক স্মরণীয় হয়েছেন তিনি পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বলা যায়, অনেকটা সাধ্যাতিত ভাষায় এই মহান কবি অলংকৃত করেছেন বসন্তের ভেতর-বাহিরের রূপরস। তার কলমের ছোঁয়ায় বসন্ত পেয়েছে ভিন্নতর মহিমা :
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত
সান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।
[ফুল ফুটুক না ফুটুক : ফুল ফুটুক]
শামসুর রাহমান স্বীকৃত নাগরিক কবি হলেও বসন্তের রং হৃদয়ে নাড়া দিয়ে গেছে তাকেও। বসন্ত বাতাস তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। বসন্ত সবাইকে সমানভাবে রাঙায়। ধনি-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বসন্তের আগমনে আপ্লুত হয়। কেননা বসন্তের সৌন্দর্য সর্বজনীন :
অকস্মাৎ প্রিয়মিলনের মতো রঙিন শাড়ির
ঝলক ছড়িয়ে আমাদের
দুঃখের ধূসর গুঁড়োগুলো বিস্মৃতির
অন্ধকারে ডুবিয়ে দাঁড়ায়
বসন্তের জ্বলজ্বলে আলো নিয়ে ধনীর প্রাসাদে,
দরিদ্রের বিরান আঙিনা আর ক্ষুধার্ত সংসারে।
[বসন্তের মায়া : না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন]
সদ্য পরলোকগত কবি ওমর আলী বসন্তের বন্দনা করেছেন অকৃত্রিমভাবে :
আবার এসেছো তুমি, প্রাচুর্যের রূপে, হে ফাল্গুন
সাজিয়ে দিয়েছো তুমি দিকে দিকে আরক্তিম ফুলে
মন্দারের শাখা, তুমি গেঁথেছো মালিকা সুনিপুণ
সে মালা শোভিত হয় যেন বনরমণীর চুলে।
[ফাল্গুনকে : এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি]
বাংলার বসন্ত চিরকালই সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যশালিনী হয়; রানীর চেয়ে ধনবতী আর রাজকুমারীর চেয়ে রূপবতী হয় এ কথা স্বীকার করেছেন কবি পূর্ণেন্দ্র পত্রী। এ সময়েই প্রকৃতির সমস্ত বৃক্ষরাজি নতুন করে যৌবনবতী হয়ে ওঠে :
শুনেছি বসন্তকালে বনভূমি অহংকারী হয়।
[বসন্তকালেই : প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ]
বসন্ত বাঙালির অতি প্রিয় একটি ঋতু। এ ঋতুতে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনেও নতুন আবহের সৃষ্টি হয়। এ ঋতু নিয়ে বাঙালির আগ্রহ চিরকালের। এ প্রিয় ঋতুর আগমন উপলক্ষে নানা স্থানে বিশেষ উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। কবি জয়গোস্বামী বিষয়টি স্বীকার করেছেন অকপটে :
অন্ধ যখন বৃষ্টি আসে আলোয়
স্মরণ-অতীত সাঁঝবেলারা সব
এগিয়ে দিতে এল নদীর ধারে-
নদীর ধারে বসন্ত উৎসব
[বসন্ত উৎসব : ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা ]
বসন্ত আমাদের সত্যি প্রিয় একটি ঋতু। জৌলুসময় এ ঋতুতে প্রকৃতি থেকে শুরু করে প্রতিটি জীবই আবেগায়িত হয়, আপ্লুত হয়। কবিরাও এ ঋতুর সৌন্দর্যে প্রভাবিত হয়ে নতুন করে উজ্জীবিত হন। কবিদের এ উজ্জীবনে বাংলা কবিতাও হয় ঋদ্ধ। জয় হোক বসন্তের, জয় হোক বাংলা কবিতার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন