সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক যুবকের ছুরি নিয়ে অতর্কিত হামলায় আহত হয়েছেন লেখক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল। তাঁকে মাথা, পিঠে ও হাতে আঘাত করা হয়। ঘটনার পরপরই তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে তাঁকে ঢাকার সিএমএইচ-এ নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের ‘ট্রিপল-ই ফেস্টিভ্যাল’ এর সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি ছিলেন। বিকেল পাঁচটার দিকে রোবটিকস গেম দেখতে তিনি দর্শকসারিতে বসেন। এ সময় পেছন থেকে এক যুবক তাঁর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। উপস্থিত ক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা হামলাকারী যুবককে গণপিটুনি দিয়ে আটক করে। ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র নিন্দা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা মিছিল-সমাবেশ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তীব্র নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। প্রত্যেকেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবী জানিয়ে জড়িতদের দ্রæত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেছে। আমরাও ড. জাফর ইকবালের ওপর এ ধরনের হামলার নিন্দা জানাই এবং দায়ী ব্যক্তিদের দ্রæত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করি।
ড. জাফর ইকবালের উপর হামলার ঘটনায় একজন আটক হলেও এর নেপথ্যে আর কারা জড়িত রয়েছে, তা এখনও রহস্যাবৃত হয়ে রয়েছে। যেহেতু হামলাকারীকে আটক করা গেছে, তাই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্তের মাধ্যমে হামলার প্রকৃত কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হবে। এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কোনো ধরনের অনভিপ্রেত মন্তব্য, এমনকি রাজনীতি করা সমীচীন হবে না। বিভিন্নমুখী প্রচারণা থেকেও বিরত থাকা উচিত। এতে প্রকৃত ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ড. জাফর ইকবালের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, এমনকি তাকে হুমকিও দেয়া হয়েছে। ফলে তার সার্বক্ষণিক নিরাত্তায় সবসময় দুজন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকতো। আমাদের কথা হচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রে ভিন্নমত থাকবে এবং থাকা স্বাভাবিক। কেউ কারো মতের সাথে একমত নাও হতে পারে, তার অর্থ এই নয়, তাকে শারিরীকভাবে আঘাত বা হত্যা চেষ্টার মাধ্যমে থামিয়ে দিতে হবে। এতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন বিনষ্ট হয়, তেমনি তা কোনো সমর্থনযোগ্য কাজ হতে পারে না। মতের বিরোধিতা যুক্তিযুক্ত মত দিয়ে করাই শ্রেয়, অস্ত্রের ভাষা বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়। আমরা লক্ষ্য করছি, গত কিছুদিন ধরে বেশ কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের জৈন্তাপুরে ওয়াজ মাহফিলে বিতর্কিত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত, অনেকে আহত এবং ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার পরপরই হবিগঞ্জের চুনারুঘাটেও আহলে সুন্নাতওয়াল জামাতের স্থানীয় এক নেতা দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন। এই দুই ঘটনার পর ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এসব ঘটনার পেছনে কোনো কুচক্রী মহলের হাত থাকা অস্বাভাবিক নয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আইএস-এর শাখা রয়েছে এবং তা সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে আইএস-এর উপস্থিতি ও কার্যক্রম নিয়ে বলে আসছে। সরকার বরাবরই এ কথা অস্বীকার করেছে এবং এর কোনো সত্যতা নেই বলে স্পষ্টভাবে বলেছে। এ প্রেক্ষিতে, ওয়াজ মাহফিল নিয়ে সংঘর্ষ এবং ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা এবং সাম্প্রতিক অন্য যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে মনে হচ্ছে, দেশে কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির পায়তারা চলছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ ভাবমর্যাদা বিনষ্টের আলামত পরিদৃষ্ট হয়ে উঠছে। এসব ঘটনা কোনোভাবেই ভিন্নখাতে প্রবাহিত বা কল্পনাপ্রসূত কোনো ধারণার দিকে ধাবিত করার সুযোগ দেয়া উচিত হবে না। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দক্ষতার সাথে ঘটনার পেছনের কারণ এবং কারা জড়িত তা উদঘাটন করে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। জনমনে বিভ্রান্তি এবং তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার আগেই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনার উদঘাটন করতে হবে। আমরা ড. জাফর ইকবালের দ্রæত সুস্থ্যতা কামনা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন