বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

আরকান রাজসভায় বাংলাসাহিত্য

ড. আ শ রা ফ পি ন্টু | প্রকাশের সময় : ৯ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বর্তমান আরকানের প্রাচীন নাম হলো ‘রোসাঙ্গ’। মোগল আমলে আরকান রাজ্যের সীমানা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চট্টগ্রামের অধিকাংশ স্থান, বিশেষ করে কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী ভূ-ভান্ড মোগল যুগের শেষ দিক পর্যন্ত রোসাঙ্গের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই চট্টগ্রাম থেকেই আরাকানে বাংলা ভাষার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে। আরকানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, যারা ‘মগ’ জাতি নামে পরিচিত; তাদের ভাষাও বাংলা নয়; অথচ এই মগদের দেশেই এক সময় বাংলা সাহিত্যের এক নতুন ধারার বিকাশ ঘটেছিল।
রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলায় মুসলিম শাসকদের অবস্থান স্থায়ী হওয়ার বহুপূর্ব থেকেই আরাকানে সাধারণ মুসলমানদের যাতায়াত ছিল। খ্রিস্টীয় আট-নয় শতকে আরাকানরাজ মহতৈং চন্দয় (৭৮৮-৮১০)-এর রাজত্বকালে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। সমসাময়িককালে চট্টগ্রামেও ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। মূলত সে কারণেই এই দুই অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। চট্টগ্রাম ও আরাকান একই রাজ্যভুক্ত হওয়ায় বৃহত্তর বঙ্গদেশ থেকে তা অনেকটাই স্বাতন্ত্র ছিল। সেই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ও রাজনীতির সূত্রে রোসাঙ্গে বসবাসরত বাঙালীদের একটি পৃথক প্রবাসী সমাজ গড়ে উঠতে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আরাকান রাজ্যে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল।
১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে রোসাঙ্গ গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন গৌড়ের মুসলমানেরা রোসাঙ্গের বর্তমানের মংডু শহরে এসে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করা শুরু করে। তবে তার পূর্বেও এখানে মুসলমানদের বসতি ছিল। এরা সবাই বাংলা ভাষাভাষী ছিল। এই সময়ে আরকানে প্রধানমন্ত্রী (মহাপাত্র), সমর-সচিব(লস্কর উজির), দেওয়ানি বা ফৌজদারি বিচারক (কাজি) ইত্যাদি উচ্চপদে মুসলমানেরা অধিষ্ঠিত ছিল। এর প্রভাব সতের শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল; যার ফলে বাংলাদেশের বাইরে স্বাধীন আরকানে বাংলাভাষা ও সাহিত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বঙ্গ-ভূভাগে মোগল-পাঠান সংঘর্ষের ফলে অনেক অভিজাত মুসলমান আরাকান রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন সুফী মতালম্বী। তখন থেকেই আরাকান রাজসভায় আরবী-ফারসীতে বিদগ্ধ কবিকুলের বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। আরাকান রাজসভায় যে সকল কবি বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- দৌলত কাজী, মরদন, কোরেশী মাগন ঠাকুর, মহাকবি আলাওল, আবদুল করীম খোন্দকার প্রমুখ। এঁরা আরবী-ফারসী কিংবা হিন্দী থেকে উপকরণ গ্রহণ করলেও মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করে স্বকীয় প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন।
সতের শতকে রোসাঙ্গ রাজ্যের যে সকল মুসলমান সভাসদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে রাজা শ্রী সুধর্মা (থিরী-থু-ধুম্মা)-এর সমর-সচিব আশরাফ খানের নাম উল্লেখযোগ্য। তারই আদেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় কবি দৌলত কাজি ‘‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’’ কাব্য রচনা করেন। দৌলত কাজি মিয়াসাধনের ‘‘মৈনা কো সত’’ কাব্য থেকে তার ‘‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’’-র উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। কাব্যটির দুই-তৃতীয়াংশ রচনার পর তিনি অকালে লোকান্তরিত হন।
আরকানরাজ শ্রী সুধর্মার রাজত্বকালে আরও একজন মুসলমান কবির আবির্ভাব ঘটে, যার নাম মরদন। তিনি ‘‘নসীরা নামা’’ নামে একটি কাব্য রচনা করেন।
পরবর্তী রোসাঙ্গরাজ সাদ উমাদার (থদো মিন্তার)-এর রাজত্বকালে তার মুখপাত্র বা প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের আশ্রয়ে থেকে মহাকবি আলাওল তার অমর কাব্য ‘‘পদ্মাবতী’’ রচনা করেছিলেন। মাগন ঠাকুর ছিলেন কোরেশ বংশোদ্ভূত মুসলমান; আরকানরাজ প্রদত্ত তার উপাধি ছিল ‘ঠাকুর’। তিনি নিজেও কবি ছিলেন; তার কাব্যের নাম ‘‘চন্দ্রাবতী’’।
রাজা সাদ উমাদারের মৃত্যুর পর তার ছেলে চন্দ্র সুধমা (সান্দ থুম্মার্) রোসাঙ্গের রাজা হন। এ সময় সৈয়দ মুহম্মদ চন্দ্র সুধর্মার সমর-সচিব ছিলেন। মহাকবি আলাওল তার আদেশে ‘‘সপ্ত(হপ্ত) পয়কর’’ কাব্য রচনা করেন। ওই সময়ে মজলিস নামক এক ব্যক্তি সুধর্মার রাজসভার ‘নবরাজ’ ছিলেন। তার আদেশে আলাওল ‘‘সেকান্দার নামা’’-র পদ্যানুবাদ করেন। একই রাজত্বকালে মন্ত্রী সৈয়দ মুসার আদেশে আলাওল ‘‘সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল’’ কাব্য রচনা করেন। এ ছাড়া কবি আলাওল দৌলত কাজির অসমাপ্ত কাব্য ‘‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’’-র বাকী অংশ সমাপ্ত করেন।
আরকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় সবচেয়ে বেশি কাব্য রচনা করেন মহাকবি আলাওল। আলাওলের মৃত্যুর পরও সে ধারা অব্যাহত থাকলেও তার মতো উৎকৃষ্ট কাব্য কেউ রচনা করতে পারেন নি। এদের মধ্যে আব্দুল করিম খন্দকার নামে একজন কবির নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে ‘‘দুল্লা মজলিস’’ নামে একটি কাব্য রচনা করেছিলেন।
গবেষকদের মতে, প্রাক-চৈতন্য যুগে ধর্মপ্রভাব মুক্ত উপকথা জাতীয় রচনার নিদর্শন না পেলেও সে সময় যে নানা ধরণের গল্প-কাহিনী প্রচলিত ছিল তা অযৌক্তিক নয়। তবে ধর্মভাবের প্রাধান্যের কারণে এ রচনাগুলো হারিয়ে গেছে। পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় ধর্ম প্রভাবমুক্ত যে সব মানবীয় প্রণয়োপখ্যান পাওয়া যায় তা মুখ্যত মুসলমান কবিদের রচনা। আর এসব অধিকাংশই রচিত হয়েছিল রোসাঙ্গ রাজসভাকে কেন্দ্র করে।
মহাকবি আলাওলের কাব্যে রোসাঙ্গ রাজসভার একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়Ñ
সুচারু রোসাঙ্গ ¯œান নানা জাতি শোভমান
শ্রী চন্দ্র সুধর্ম নরপতি।
অস্ত্রে-সস্ত্রে সুপÐিত ব্রতকর্মে সুচরিত
খলনাশ দুঃখিতের গতি।...
হেন ধর্ম্মশাল রাজা অতুল মহত্ব।
মজলিস নবরাজ তার মহা অমাত্য।।
রোসাঙ্গ দেশেতে আছে যত মুসলমান।
মহাপ্রাত্র মজলিস সবার প্রধান।।
এ থেকে বোঝা যায় আরাকানে মুসলিম প্রভাব বলিষ্ট ও ব্যাপক ছিল। ‘বর্মী’ আরকানিদের মাতৃভাষা হলেও ব¯‘ত বাংলাভাষার ওজস্বীগুণের কারণেই সেখানে তা দ্বিতীয় ভাষা রূপে গৃহিত হয়েছিল। রোসাঙ্গ রাজারা মূলত বৌদ্ধ হলেও ধর্ম সহিষ্ণুতার কারণেই হয় তো সেখানে হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতি প্রভাবিত সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। তাই আরকানবাসীদের সহৃদয়তা ও গুণগ্রাহিতার কাছে বাংলা সাহিত্য অনেকটাই ঋণী। বর্তমানে যা অকল্পনীয় ব্যাপার।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন