স্বাধীনতা সংগ্রামী সৈয়দ নিসার আলি ‘তিতুমীর’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। কৃষক বিদ্রোহের নেতা হিসেবেও তাঁরা নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিতুমীর ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। কারো মতে তিনি ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ভূমিষ্ট হন। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি কৃষকের ঘরেই তাঁর জন্ম। উত্তর চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত চাঁদপুর যাঁর নাম বর্তমান হায়দারপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে তিনি প্রায়ই ঘুষঘুষে জ্বরে ভুগতেন। রোগমুক্ত হওয়ার জন্য তৎকালীন গ্রাম্যধারা অনুযায়ী চিকিৎসামতে প্রায়ই শিউলিপাতা বা অনুরূপ অন্যান্য তেতো পাতার রস রোগীকে খেতে হত। তিতুমীর ‘তিতাপাতা’ খেতে আপত্তি করতেন না বলে জয়নাব খাতুন আদর করে নাতিকে তিতামিঞা বলে ডাকতেন। পরবর্তীকালে মীর তিতামিঞা ‘তিতুমীর’ নামে অভিহিত হন। কিশোর বয়সে কৃষিকার্যে নিযুক্ত থাকায় তাঁর স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল। শরীরচর্চার সঙ্গে তিনি মল্লযুদ্ধ, লাঠি-সড়কি চালনা এবং অন্যান্য ক্রীড়ায় পারদর্শী হয়ে উঠেন।
সে-সময় অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শেষপাদে এ দেশে চোর-ডাকাতের যথেষ্ট উপদ্রব ছিল। আর ছিল জমিদারের ভাড়াটে গুন্ডাদের অত্যাচারও। ওই সব অত্যাচারীর হাত থেকে দেশের জনসাধারণকে রক্ষা করার একটা সংকল্প তিতুমীরের মনে ধীরে ধীরে দানা বাঁধে। এরপর তিতুমীর কৃষিকাজ ছেড়ে দেন এবং কলকাতায় পেশাদারি পালোয়ান হন। পরে তিনি নদিয়ার কোনো এক জমিদারের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। অন্য এক জমিদারের সঙ্গে ওই জমিদারের বিরোধ সৃষ্টি হলে শেষ পর্যন্ত দাঙ্গা লেগে যায়। তিতুমীর সেই দাঙ্গায় অংশ নিয়ে আইন অনুসারে অভিযুক্ত হন এবং যশোর জেলে আবদ্ধ হন। কারাবাসের সময় থেকেই তাঁর বেদনাহত মন মানবমুক্তির পথ সন্ধান করতে থাকে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, তিতুমীর সিলেটের ভারতবিখ্যাত পীর হজরত শাহজালালের অন্যতম সুযোগ্য শিষ্য। পীর হজরত গোরাচাঁন হাড়োয়া খাসবালান্দা রাজীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সৈয়দ শাহাদাত আলির একত্রিশতম অধস্তন পুরুষ। তখনকার দিনে একটা ধারণা মানুষের মনে অত্যন্ত দৃঢ় ছিল-‘ধর্মই মানুষকে পরম মুক্তি দিতে পারে।’ হয়তো সেই আশাতেই তিতুমীর মক্কা শরিফে গমন করেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে সংযোগ ঘটে শাহ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর। তাঁর সাহচর্যে এসে তিতুমীর হারানো মানসিক স্থৈর্য ফিরে পান। এই ব্রেলভী ভারতের অযোধ্যা রাজ্যের রায়বেরিলিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিতুমীর তাঁর কাছেই দীক্ষা নেন। কিছুদিন পর তিনি দেশে ফিরে এসে আদর্শ প্রচারে দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে নিয়োগ করেন।
দরিদ্র মুসলিম কৃষক সমাজে তিতুমীরের প্রভাব ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১৮৩১ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত তিতুমীর জমিদারের কাছে হয়ে উঠেছিলেন প্রায় অপ্রতিরোধ্য। ভূষাণার জমিদার মনোহর রায়ও তিতুমীরের দলভুক্ত হয়ে শক্তিসামর্থ ও অর্থসাহায্য দেন। ঊনবিংশ শতকের প্রথম থেকেই নীলচাষীদের উপর ইংরেজদের প্রচন্ড অত্যাচার শুরু হয়েছিল। সেরা জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করা, জমি মাপজোকের সময় কারচুপি করা, কুঠিতে নীল জমা নেবার সময় ওজনে ঠকানো, নানাবিধ নির্যাতন ও গালিগালাজ চলতে থাকে প্রতিদিন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম আইনে দাদন নিয়ে নীলচাষ না-করা আইনবিরুদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় অত্যাচার ক্রমে চরমে উঠে। এসব কথা ও বহুদিনের পঞ্জীভূত ক্ষোভ কৃষকরা ভুলতে পারেনি। তিতুমীরের অনুগামীরা সাহেবদের দেওয়া দাদনের কাগজপত্র নষ্ট করে কৃষকদের বাঁচাবার জন্য একের পর এক নীলকুঠি আক্রমণ করতে থাকে। বারঘরিয়ার অভিযান তাদের সফল হয়, হুগলির নীলকুঠির তারা তছনছ করে দেয়। বারঘরিয়া ও হুগলির নীলকুঠির মালিক ছিলেন উইলিয়াম স্টর্ম। তার বারঘরিয়া কুঠির ম্যানেজার মিস্টার পিঁরো ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর তিতুমীরের শক্তিবৃদ্ধি ও নীলকুঠির উপর আক্রমণের ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংবাদ পাঠান। বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার আলেকজান্ডার ১১ নভেম্বরে পত্র পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি তৎক্ষণাৎ বিভাগীয় কমিশনার মি. বারওয়েলকে বিষয়টি জানালেন। কমিশনার সাহেবও সরেজমিন-তদন্তে পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঊর্ধ্বতন সরকারপক্ষকে রিপোর্ট দিলেন ১৪ নভেম্বর আলেকজান্ডার সাহেব সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বাগান্ডির নেমোকপোক্তানস্থিত সিপাহিসহ সদলবলে নারকেলবেড়িয়ার মাঠে উপস্থিত হলেন। তিতুমীরকে ভয় দেখানোর জন্যে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করলেন এই ইংরেজ পুরুষ। যুদ্ধ ঘোষণায় সাড়া দিয়ে তিতুমীরের বিদ্রোহী বাহিনী সেই গুলির আওয়াজ গ্রাহ্য না করে সিপাহিদের আক্রমণ করল। সেই যুদ্ধে বসিরহাটের দারোগা, জমাদারসহ বহু সিপাহি বন্দি হল। আলেকজান্ডার সাহের ঘোড়ায় চেপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। ১৪ নভেম্বর মি. স্থিথ তিতুমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযান করেন।
ইতোমধ্যে তিতুমীর নির্মাণ করেছেন তাঁর ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা। ১৫ নভেম্বর ১৮৩১-এর বিদ্রোহীরা বারঘরিয়া নীলকুঠি আক্রমণ করে। তারা পিরোঁ সাহেবকে না-পেয়ে তাঁর কুঠি ও বাংলো ধ্বংস করে। বইপত্র যা পায় সব ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। ১৬ নভেম্বর স্মিথ সাহেব বারঘরিয়া পৌঁছে শুধু ধ্বংসস্তূপই দেখতে পান। স্টর্ম সাহেবের হুগলি কুঠির ম্যানেজার ছিলেন মি. হেনরি ব্লন্ড। বিদ্রোহীরা হুগলির নীলকুঠি আক্রমণ করে এবং ব্লন্ড সাহেব ও তাঁর স্ত্রী শিশুপুত্রকে ধরে নিয়ে বাঁশের কেল্লায় তিতুমীরের সামনে হাজির করে। সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও তিতুমীরের পক্ষে নীল চাষ করার প্রতিশ্রতিতে ব্লন্ড সাহেব সপরিবারে মুক্তি পান। অবশ্য বাঁশের কেল্লা ইংরেজদের দখলে এলে তিনি তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক হলফনামা দিয়েছিলেন।
এরপর স্মিথ সাহেব মোল্লাহাটি ও রুদ্রপুর, নীলকুঠির মালিক মি. এন্ড্রুজের সাহায্য নেন। তাঁর কাছে থেকে সাতটি হাতি, আশেপাশের জমিদার ও তাদের লড়াকু লোকজন সংগ্রহ করে তিনি তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্রসর হন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বরের যুদ্ধে নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ সাহেবও যখন পরাজিত হলেন, তিনি বিষয়টি সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ ভেবে সরকারকে জোরালোভাবে রিপোর্ট পেশ করেন।
ইতোমধ্যে তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি ১৮ নভেম্বর ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে গোবরডাঙ্গা ও অন্যান্য জমিদারের কাছে তাঁর নামে রাজস্ব পাঠাবার পরওয়ানা পাঠিয়ে দেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়েছে। এবার ব্রিটিশ সরকার চরম আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হল। বাঁশের কেল্লায় শেষ আক্রমণ হয় ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর। তিতুমীরকে দমন করার জন্য সরকার থেকে কামান, গুলিগোলাসহ সৈন্যদল প্রেরিত হল। সেনাপতি ছিলেন সাজারল্যান্ড সাহেব। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ সাহেব, কয়েকটি নীলকুঠির মালিক স্টর্ম সাহেব, বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার সাহেব প্রমুখ।
দেড়ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলে। এরপরে নারকেলবাড়িয়ার মাঠে তিতুমীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হল। তিতুমীর কামানের গোলার আঘাতে নিহত হন। তাঁর ছেলে গহরের ডান পা বিনষ্ট হয়। কেউ কেউ বলেন যে, তিতুমীরের ছিন্নভিন্ন দেহ হুগলি গ্রামের লোকেরা কবরস্থ করে। আবার কারো কারো মত এই যে, যুদ্ধের শেষে আলেকজান্ডার সাহেব তাঁর মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন যাতে তাঁর অনুগামীরা তিতুমীরকে শহিদের মর্যাদা দিতে না পারে এবং স্মারক স্তম্ভ নির্মাণ করতে না পারে। এই নির্দেশের পেছনে ছিল বিদ্রোহের আগুন পুনরায় প্রজ্বলিত না-হওয়ার প্রেরণা।
বাঁশের কেল্লাটি আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছিল। তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুমকে ওই গ্রামে ফাঁসি দেওয়া হয়। তাই ওই স্থানটির নাম হয় ফাঁসিতলা। বহু বিদ্রোহী নিহত হয়। বন্দিদের ১২৫ জনকে ২ থেকে ৭ বছরের কারাদন্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ১ জনের মৃত্যুদন্ড হয়। বিচারের পূর্বেই মারা যান ৪ জন। মোট অভিযুক্ত ছিলেন ৩৩৩ জন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাজন গাজি। মিসকিন ফকির নামে এক ব্যক্তি তিতুমীর উৎসাহ পরামর্শদাতা ছিলেন তিনি লড়াইয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিদ্রোহীদের উৎসাহিত করে কোথায় অন্তর্হিত হয়েছিলেন তা অজ্ঞাত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন