(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
হযরত যায়েদ (রা) ও ইবনে আব্বাস (রা) এর পরস্পর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা:
এতো কঠোর মতবিরোধ থাকা সত্তে¡ও তাঁদের উভয়ের মাঝে নজীরবিহীন আদব, সম্মানবোধ ও মহব্বত ছিল। একবার হযরত যায়েদ (রা) কোথাও থেকে প্রর্ত্যাবর্তন করছিলেন। এমতাবস্থায় মুখোমুখী হলে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হযরত যায়েদের বাহনের লাগাম ধরে অনেকটা ভৃত্তের ন্যায় তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন! হযরত যায়েদ (রা) বললেন, হে প্রিয়নবী (স) এর চাচার পুত্র! আপনি লাগাম ছেড়ে দিন, এমনটি করে আমায় লজ্জা দিবেন না! হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলে উঠলেন, আরে! আমাদের তো এমনই শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, আলেমদেরকে ও বড়দেরকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। হযরত যায়েদ (রা) বললেন, আপনার হাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিন! ইবনে আব্বাস (রা) হাত প্রসারিত করলে হযরত যায়েদ (রা) তাতে চুমু খেলেন এবং বললেন, আমাদেরকেও প্রিয়নবী (স) এর পরিবারস্থ ও বংশধরদের সঙ্গে এমনই ব্যবহার করতে নির্দেশে দেয়া হয়েছে। (কানযুল উম্মাল: খ-৭, পৃ-৩৭ )। যখন হযরত যায়েদ (রা) এর ইন্তেকাল হলো, তখন হযরত ইবনে আব্বাস (রা) শোকাতুরভাবে বললেন, “ইলমজ্ঞান বিদায় নিয়ে যাচ্ছে”! অপর বর্ণনায় পাওয়া যায়, “জ্ঞান-ইলম এভাবেই চলে যায়। আজকে ইল্ম-জ্ঞানের অনেক বড় অংশ দাফন করা হয়ে গেল”! (সুনানে বায়হাকী: খ-৬,পৃ-২১১ )
(চার) চতুর্থ উদাহরণ: হযরত আলী (রা) ও হযরত তালহা (রা) এর বিরোধ
হযরত আলী (রা) ও হযরত তালহা (রা) এর মাঝে হযরত উসমান (রা) এর ‘কিসাস’ ও প্রতিশোধ প্রশ্নে বিরোধ ছিল। বিষয়টি এমন পর্যায়ে গড়িয়েছে যে, উষ্ট্রযুদ্ধে হযরত তালহা (রা) হযরত আলী (রা) এর বিপক্ষে লড়াইতে অংশ নিয়েছিলেন!
উভয়ের পরস্পর সম্পর্ক ও ভালোবাসা:
তাঁদের পারস্পরিক মহব্বত ও আন্তরিক সম্পর্ক এ পরিমাণ ছিল যে, উষ্ট্রযুদ্ধের পর হযরত আলী (রা) এর সাক্ষাৎ ঘটেছিল হযরত তালহা (রা) এর পুত্র এমরান এর সঙ্গে। হযরত আলী (রা) তার কাছে পরিবারস্থ সকলের খোঁজ-খবর নিলেন এবং বললেন, আমি আশাবাদী যে, মহান আল্লাহ আমাকে ও তোমার পিতাকে ওইসব লোকের মধ্যে গণ্য করবেন যাঁদের সম্পর্কে তিনি ইরশাদ করেছেন-(“আমি তাদের অন্তর হতে বিদ্বেষ দূর করবো: তারা ভাই ভাই হয়ে পরস্পর মুখোমুখী আসনে (জান্নাতে) অবস্থান করবে।” (আল কুরআনুল কারীম: ১৫:৪৭)
কিছু সংখ্যক তাবেয়ী ওই মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা অবাক হলেন এবং বলতে লাগলেন: মহান আল্লাহ ক্ষমা করুন! এরা গতদিনই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করলো! আর এখনই আবার বেহেশতে তাঁর সঙ্গে ভাই-ভাই হয়ে গেল! হযরত আলী (রা) এদের উক্তি শুনে রাগান্বিত হয়ে গেলেন এবং বললেন, যাও! তোমরা এখান থেকে উঠে যাও! যারা আল্লাহ্তা‘আলার দান ও ক্ষমা থেকে দূরে অবস্থান করছো! অমঙ্গল কামনা ও চিন্তা করছো! আমি ও তালহা (রা.) একই সঙ্গে জান্নাতে অবস্থান করতে না পারলে, তা আর কে পারবে? অর্থাৎ এমন সব পবিত্র বাণীর বাস্তবায়ন আর কাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে ?! ( তাবাকাতে ইবনে সা’দ: খ-৩,পৃ-২২৪)
(পাঁচ): পঞ্চম উদাহরণ: হযরত আলী (রা) ও হযরত মুআবিয়া (রা) এর বিরোধ
হযরত আলী (রা) ও হযরত আমীর মুআবিয়া (রা) এর মাঝেও হযরত উসমান (রা) এর বিচার ও ‘কিসাস’ প্রশ্নে প্রচন্ড বিরোধ হয়েছিল। এমনকি কিছু ভুল বুঝাবুঝির কারণে পরস্পর লড়াইও হয়েছিল যা সকলের জানা।
উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক:
জনৈক ব্যক্তি হযরত আলী (রা)-কে উষ্ট্রযুদ্ধ সম্পর্কে প্রশ্ন করলো,যারা আপনার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো তারা কি মুশরিক ছিল? তিনি উত্তরে বললেন, না তাঁরা শিরক থেকে অনেক দূরে ছিলেন। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, তারা কি মুনাফিক ছিল? তিনি উত্তরে বললেন: না, মুনাফিকরা তো ইবাদত-বন্দেগী স্বল্পই করে থাকে। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, তাহলে তাদের অবস্থান কি? তিনি জবাবে বললেন: “তাঁরাও আমাদের ভাই-যাঁরা আমাদের সঙ্গে মতবিরোধ করেছিলেন মাত্র।” (সুনানে বায়হাকী: খ-৮,পৃ-১৭৭।)
বর্ণনাকারী আবূ সালেহ বলেন, একদা ‘দ্বারার ইবন দামরাহ্ কেনানী’ হযরত আমীর মুআবিয়া (রা) এর কাছে এলেন। হযরত মুআবিয়া (রা) তাকে বললেন, তুমি হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে, তাঁর কিছু গুণাবলী আমাকে শুনাও! তিন বললেন, এ ব্যাপারে আমাকে ক্ষমা করুন! হযরত মুআবিায়া (রা) একাধিকবার অনুরোধ করায় তিনি বললেন: “মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনি একজন উচ্চমানের দূরদর্শী, পরিণামদর্শী ও বীর পুরুষ ছিলেন। তাঁর কথা-বক্তব্য মীমাংসাজনক এবং বিচার-নির্দেশ ছিল ইনসাফপূর্ণ। তাঁর চারিদিক থেকে জ্ঞান-বিদ্যা ও প্রজ্ঞার বর্ণনা ধারা প্রবাহিত হতো। জাগতিক চাকচিক্য থেকে দূরে অবস্থান করে রাতের নির্জনতাকে তিনি সজীব রাখতে অভ্যস্থ ছিলেন। আল্লাহর কসম! তিনি অনেক বেশী কান্নাকাটি করতেন; সর্বদা গভীর চিন্তা- চেতনায় ডুবে থাকতেন। কখনও নিজের হাতের তালু নাড়াচড়া করতেন এবং নিজ মনে কি যেন বলতেন! একেবারে সাদাসিদে পোষাক ও সাধারণ খাবার পসন্দ করতেন।
আল্লাহর শপথ! তাঁকে মনে হতো আমাদের মতোই একজন। আমরা যখন তাঁর কাছে যেতাম, তিনি আমাদের তাঁর কাছেই স্থান দিতেন এবং আমাদের কথার জবাব দিতেন। কিন্তু তাঁর এতো কাছে অবস্থান করা সত্তে¡ও তাঁর গভীর প্রভাব আমাদের মনে জাগরুক থাকতো, অনেক সময় কথা বলতে সাহস পেতাম না। তিনি যখন হাঁসতেন দাঁতগুলো মুক্তার মতো দৃষ্টিগোচর হতো। তিনি ধর্মভীরুদের সম্মান করতেন, মিসকীন ও দরিদ্রদের ভালোবাসতেন। কোনো ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁর দ্বারা অন্যায় কিছু করিয়ে নেয়া বা তেমন আবদারেরও সাহস পেত না এবং কোনো দূর্বল অসহায়ও তাঁর ন্যায় বিচার প্রশ্নে নিরাশ হতো না।
আমি মহান আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলছি, রাতের অন্ধকারে তাঁকে আমি দেখেছি, তিনি মেহরাব এর মাঝে বসে নিজের দাঁড়ি চেপে ধরে এমন অস্থিরভাবে কাতরাচ্ছেন যেমন কিনা কোনো বিচ্চু তাঁকে দংশন করেছে এবং কোনো বিষন্ন ব্যক্তি ও নিপীড়িত ব্যক্তি জার-জার হয়ে রোদন করছে! আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন তাঁর সেই করুণ কান্নার শব্দ এখনও আমার কানে বাজতেছে! তিনি বলছিলেন, “হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক........! আর এভাবে মহান আল্লাহর দরবারে ক্রন্দন করছিলেন এবং দুনিয়াকে সম্বোধন করে বলছিলেন, তুমি আমার সম্মুখে এসে দাঁড়াচ্ছ! তুমি আমাকে ঘিরে ফেলতে চাচ্ছ! পরিতাপ! পরিতাপ! দূর হও! অন্য কাউকে প্রতারিত করো! আমি তোমাকে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছি। হে দুনিয়া! তোমার বয়স খুবই স্বল্প, তোমার জমায়েত অত্যন্ত তুচ্ছ ও ঘৃন্য এবং তোমার স্বাদ আস্বাদন অত্যন্ত নগন্য। আহ্! আহ্! আহ্! পথের পাথেয় কত অল্প, সফর কত দীর্ঘ, আর পথ-পরিক্রমা কত ভয়ানক!”
এসব শুনে হযরত আমীর মুআবিয়া (রা) স্বীয় অশ্র সংবরণ করতে পারলেন না। তাঁর দাঁড়ি অশ্রসিক্ত হয়ে গেল। তা তিনি পরিধেয় জামার আঁচল দ্বারা মুছতে শুরু করলেন। উপস্থিত লোকজনও ঢুকরে কান্না শুরু করলেন। তখন আমীর মুআবিয়া (রা) বলে উঠলেন, আবুল হাসান আলী (রা) বাস্তবে এমনই ছিলেন! আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি দয়া করুন! ” (আল-হিলয়া: আবূ নুআঈম: খ-১,পৃ-৮৪)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন