শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মৃত্যু থেকে ফিরে আসা ৭ যাত্রীর লোমহর্ষক বর্ণনা

ইউএস বাংলা বিমান দুর্ঘটনা

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:২৬ এএম, ১৫ মার্চ, ২০১৮

নেপালের কাঠমান্ডের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৪ ক্রুসহ ৬৭জন যাত্রীর মধ্যে ৫০ জন যাত্রীই নিহত হন। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছেন কয়েকজন মাত্র। তবে বেঁচে ফিরে আসতে পারলে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময়কার লোমহর্ষক সেই মুহূর্তগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তারা। বার বার দুর্ঘটনার কথা মনে করে শিউরে উঠছেন বেঁচে ফেরা মানুষগুলো।
আর এদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সাথে লড়ছেন। এতো বড় একটি দুর্ঘটনাটি থেকে বেঁচে ফিরে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তারা এখনো বেঁচে আছেন। বিধ্বস্ত ইউএস বাংলা থেকে বেঁচে ফেরা ৭ যাত্রী জানালেন তাদের লোমহর্ষক বর্ণনা। বিধ্বস্ত ইউএস বাংলা বিমান থেকে বেঁচে ফেরা সনম শাকিয়া নামে বিমান যাত্রী বলেন, বিমানটি একবার ওপরে, একবার নিচে, একবার ডানে, একবার বাঁয়ে পাক খাচ্ছিল। প্রথমে আমি ভাবলাম, বিমান নামার সময় মনে হয় এমনটাই ঘটে থাকে। পরে যখন বিমানটি বিস্ফোরণ হয় তখন আমি জানালা দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলাম।
বেচেঁ যাওয়া আর এক যাত্রী শাহরীন আহমেদ (২৯)। যিনি বর্তমানে কাঠমাÐু মেডিকেল কলেজ টিচিং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন তিনি। বেড়ানোর উদ্দেশে নেপাল যাচ্ছিলেন তার এক বন্ধুর সাথে। কিন্তু দুর্ঘনার হাত থেকে তিনি বেঁচে ফিরলেও তার বন্ধু নিহত হন।
সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ওই দুপুর আড়াইটার দিকে কাঠমাÐু পৌঁছে পাইলট প্রথমে ল্যান্ড করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেননি। পরে আকাশে কিছুক্ষণ ঘোরার পর যখন দ্বিতীয়বার ল্যান্ড করার চেষ্টা করেন, তখন বিমানের একপাশ উঁচু হয়ে যায়। তখনই আমি বললাম, বাঁ দিকটা উঁচু হলো কেন! আর তখনই ক্রাশ হয়ে গেল। এরপরই বাইরে হঠাৎ প্রচÐ আগুন দেখতে পেলাম। আর আমাদের কেবিন ধোঁয়ায় ভরে গেল এবং বিকট শব্দে হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটল। আগুন লাগার প্রায় ২০ মিনিট পর উদ্বারকারীরা সাহায্য করতে আসেন। সে পর্যন্ত বিমানের ভেতরেই বসেছিলাম। প্রচÐ ভয় লাগছিল আর হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করছিলাম।
শাহরীন আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে আরো বলেন, ‘বিমানে থাকা মানুষগুলো পুড়ে যাচ্ছিল। তারা চিৎকার করছিল এবং বিমান থেকে পড়ে যাচ্ছিল। আমি জ্বলন্ত বিমান থেকে তিনজনকে লাফ দিতে দেখেছি। এটা ভীষণ ভয়ানক পরিস্থিতি ছিল। এরপর সৌভাগ্যবশত কেউ আমাকে সেখান থেকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যায়।
স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির পরিবারের ৫ জন মিলে কাঠমান্ডু ঘুরতে গিয়েছিলেন সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা। সাভারের গণস্বাস্থ্য মেডিকেল থেকে কয়েক দিন আগে এমবিবিএস পাস করেছেন। স্বামী মেহেদী হাসান জীবনবাজি রেখে বাঁচিয়েছেন তাকে। দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন ভাসুর (স্বামীর বড় ভাই) ও ভাসুরের আড়াই বছরের সন্তানকে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তার জা। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পাওয়া স্বর্ণা বর্তমানে কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ (কেএমসি) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। বুধবার সকালে আইসিইউতে গিয়ে বাংলাদেশি সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি স্বেচ্ছায় কথা বলতে রাজি হন। দুর্ঘটনার সময় ফ্লাইটের ভেতরের অভিজ্ঞতার বর্ণনার অডিও রেকর্ড স্বর্ণার অনুমতি নিয়ে ধারণ করা হয়েছে।
আমরা ১৪ নম্বর সিটে বসেছিলাম। পাঁচজন পাঁচটি সিটে ছিলাম। ১৪-এ এবং ১৪-সি’তে আমি আর আমার স্বামী, ১৪-ডি এবং ১৪-এফ সিটে আমার ভাইয়া ও ভাবি বসেছিলেন। ভাবি জানালার পাশে ছিলেন। প্রথমে আমি জানালার কাছে বসলেও ল্যান্ডিংয়ের সময় আমার স্বামী জানালার কাছে বসে।
অবতরণের সময় প্লেনটা একটু ঝাঁকি খেয়েছে। কেবিন ক্রুরা ল্যান্ডিংয়ের ঘোষণা ছাড়া কোনো ঘোষণা দেয়নি, কোনো সতর্ক সংকেত দেয়নি। তবে ওনারা বুঝতে পারছিলেন প্লেনটা ভালোভাবে চলছে না। প্লেন এয়ারপোর্টে আসার পর দেখছি রানওয়ে ও অন্যান্য প্লেন বাঁকা হয়ে আছে। বুঝতে পারছিলাম আমাদের প্লেনটিই বাঁকা হয়েছিল। এরপরও পাইলট প্লেনটা ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেছেন, বাঁকা থেকে সোজা করার চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পর আবার প্লেনটা কাঁপছিল, সঙ্গে সঙ্গে সামনের চার-পাঁচটা গøাস ভেঙে গেল, সামনের যাত্রীরা বলছিল ‘বø্যাস্ট বø্যাস্ট’। তখন প্লেনটি পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। আমার পায়ের নিচে আগুন ধরে গিয়েছিল। আমি তখন চিৎকার করে বলছিলাম, ‘আমি মরতে চাই না। আমি আগুনে পুড়ে মরতে চাই না।’ আমার স্বামী তখন কেডস পরা অবস্থায় পা দিয়ে জানালা ভাঙার চেষ্টা করছিলেন।
বিপদের সময় মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। আমার স্বামী অনেকটা মাথা খাটিয়ে চেষ্টা করেছে ওখান থেকে আমাকে বের করার। প্লেনের সামনের অংশটা ভেঙে গিয়েছিল। আমাদের কাছাকাছি চার-পাঁচটি সিটও ভেঙে গিয়েছিল, সেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, সেই জায়গা থেকে আলো আসছিল। তখন আমার স্বামী কোনো মতে ওইদিক দিয়ে বের হয়েছে। তারপর উনি (স্বামী) আমাকে ডাকলেন, ‘তুমি আস।’ তখন ভাবি এগিয়ে এসে ওই ফাঁকাটা দিয়ে ঢুকে গেছেন। আমি বের হতে পারিনি। ওই সময় আমার মাথার উপর বক্সটা ভেঙে গিয়েছিল (মাথার ওপর হ্যান্ড ব্যাগেজ রাখার কেবিন)। সে সময় আমি আমার ভাসুরকে দেখতে পাচ্ছিলাম। উনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, শিশুটা ছিটকে পড়ে গিয়েছিল।
অনেক মানুষের মাথা দেখতে পাচ্ছিলাম। তারা বের হওয়ার চেষ্টা করছিল অথবা বের হতে পারছিল না। কারণ তারা শরীর নাড়াতে পারছিল না। ভাইয়া (ভাসুর) যেখানে ছিল সেখান থেকে আগুন জ্বলছিল, ধোঁয়া এসে আমার নাকে লাগছিল। মনে হচ্ছিল এ আগুনে পুড়েই তো মরে যাব। এরপর আমার মাথাটা কোনো মতে প্লেনের ভাঙা অংশ দিয়ে বের করি। আমার হাসব্যান্ড যতটুকু গিয়েছিল ততটুকু আবার ফেরত এসেছে তারপর আমার হাত ধরে টেনে বের করেছে। তা না হলে আমি বের হতে পারতাম না, কারণ আমার শরীরে কোনো শক্তি ছিল না। বের হওয়ার পর ঘাসের উপর পড়েছিলাম।
প্লেনটি ক্রাশ এবং ভেতরে ধোঁয়া সৃষ্টি হলেও কোনো অক্সিজেন মাস্ক বের হয়নি। ইমার্জেন্সি অ্যালার্মও দেয়নি। একটা প্লেনে অক্সিজেন মাস্ক থাকবে না? যখন দুর্ঘটনায় পড়বে তখন অক্সিজেন মাস্ক তো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের হওয়ার কথা। অক্সিজেন থাকলে অনেক মানুষ সুস্থ থাকত, অন্তত শ্বাস নিতে পারত। যদি অক্সিজেন মাস্ক থাকত তবে অনেকে সজ্ঞান থাকত এবং বের হতে পারত। মানুষ বেরই হতে পারেনি। আমি ধোঁয়া খেয়েছি, আমি বুঝতে পারছি। ধোঁয়ার কারণে মাথাটা ঘুরে উঠে, কিছু বোঝা যায় না, অজ্ঞান অজ্ঞান লাগে।
আমার পর আরও দুই-তিনজন মানুষ বের হয়েছিল। আমরা বের হওয়ার ২ মিনিটের মাথায় বড় একটা শব্দ হয়। চোখের সামনে বিধ্বস্ত প্লেনের আগুন জ্বলতে দেখছিলাম। যারা উদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিস, তাদের আমার অভিজ্ঞ মনে হলো না। তারা আগুন কন্ট্রোলে আনতে পারছিল না। তাদের কেউ ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল না। একটু বøাস্ট হলেই সবাই পেছনে দৌড়ে চলে যাচ্ছিল।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া আরেক বাংলাদেশি মেহেদি হাসান। প্রথমবারের মতো বিমান ভ্রমণ করছিলেন তিনি। তার স্ত্রী, এক আত্মীয় এবং ওই আত্মীয়ের মেয়ে সঙ্গে ছিল। মেহেদি বলেন, আমার সিটটি পেছনে ছিল। আমি আগুন দেখে পরিবারকে খুঁজতে শুরু করলাম। আমরা জানালা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। আমাদেরকে উদ্ধার করতে পারে এমন মানুষকে খুঁজছিলাম। আমি আর আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করা হলো। কিন্তু আত্মীয়দের পাওয়া যায়নি।
বসন্ত বহরা নামে আরেক যাত্রী বিমান বিধ্বস্তের সময়কার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘হঠাৎ করেই বিমানটি প্রচÐ রকম কাঁপতে শুরু করে এবং মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। আমি জানালার কাছে ছিলাম। সেটি ভাঙতে পারায় আমি প্রাণে রক্ষা পাই। তারপর আর কিছু মনে নেই।’
কেশব পাÐে নামের এক নেপালি যাত্রী বলেন, ‘বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর আমি বের হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমার হাত ও পা আটকে যাওয়াতে বরে হতে পারছিলাম না। আমার সিট ছিল জরুরি নির্গমন দরজার পাশেই। সম্ভবত সেখান দিয়েই উদ্ধারকর্মীরা আমাকে বের করেছেন। এর বেশি কিছু মনে নেই ।
আশীষ রণজিৎ নামের এক যাত্রী বলেন,আমি এয়ার হোস্টেজকে জিজ্ঞাসা করি, কী হচ্ছে, সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো? তিনি আমাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বোঝান, সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, তাঁর চেহারার মধ্যে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মারিয়া ১৫ মার্চ, ২০১৮, ২:৩৯ এএম says : 0
আহতদের সুস্থতা কামনা করছি
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন