এম এস এমরান কাদেরী, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম থেকে ঃ জিকা ভাইরাস, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো মারাত্মক রোগবাহী বিষাক্ত মশা নিয়ে পৃথিবীব্যাপী যখন হৈচৈ ও চুলছেড়া বিশ্লেষণ চলছে, ঠিক এমন একটি মুহূর্তে সময়োপযোগী মশক নিধনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে কম খরচের নিত্যনতুন যন্ত্রের আবিষ্কার নিয়ে প্রকাশ্যে আসেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ের আবদুল হামিদ (৩০) নামের এক উদ্যমী যুবক। বিশ্বের প্রায় সব দেশে মশা নিধনের জন্য বিভিন্ন উপায় বের করলেও এসব উপায়ে রয়েছে রাসায়নিক পদার্থ। যা মানব দেহে সৃষ্টি হয় বেশ ক্ষতিকর মরণঘাতী ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ভয়াবহ রোগ। সেই সঙ্গে মারাত্মকভাবে আঘাত হানে বায়ু ও পরিবেশে। আর এমন এক কঠিন সময়ে অত্যাধুনিক দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব মশা নিধনের এ যন্ত্রটি আবিষ্কার করে আবদুল হামিদ কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেন।
জানা যায়, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি অত্যাধুনিক ও অসাধারণ কিছু আবিষ্কার করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করেন বোয়ালখালীর অজপাড়াগাঁয়ের পোপাদিয়ার হাজী শামসুল হকের পুত্র মো. আবদুল হামিদ। ছোটবেলা থেকেই তার ধ্যান ছিল লাল-সবুজের নয়নাবিরাম ও সুশোভিত বাংলাদেশের মানচিত্রকে বিশ্বের দরবারে আধুনিকতার বাহক-ধারক ও উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত করার। সেই লক্ষ্য মাথায় নিয়ে ২০১১ সাল থেকে শুরু করেন গবেষণা। একাধিক বিষয়ে গবেষণা শুরু করলেও ২০১৪ সালে অত্যাধুনিক দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব মশা নিধক এ যন্ত্রটি আবিষ্কারের সফলতা অর্জনে সামর্থ্য হন আবদুল হামিদ। এরপর মশা নিধক এ প্রযুক্তিকে আন্তর্জাতিক মান দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। আ. হামিদের আবিষ্কৃত মশা নিধক এ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতির প্রত্যয়ে প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট বিভাগে। আবেদনে এ প্রযুক্তির নাম দেন ‘এইচইসি মশকিটো কিলার’। অর্থাৎ তার নামের সঙ্গে মিল রেখেÑ হামিদ ইলেকট্রো কেমিক্যাল মশকিটো কিলার।
জানা যায়, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে আবিষ্কৃত এ যন্ত্রটির বিশেষত্ব ও গুণ হলোÑ এটিতে মানবদেহের ক্ষতিকারক কোনো পদার্থ নেই, নেই বিষাক্ত ধোঁয়া ও শব্দ, যা সাধারণ কয়েল ও স্প্রের মতো বায়ু দূষণ করে না, দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব, সহজে বহনযোগ্য, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী, স্থায়ীভাবে মশা নিধনে সক্ষম। শুধুমাত্র ১০০ টাকার একটি রিপিল দিয়ে প্রায় ৪ মাস পর্যন্ত চলে। ১ ফুট উচ্চতা, ৬ ইঞ্চি প্রশস্থ (টেবিল লাইটের মতো) এই যন্ত্রটির ওজন হবে ৫/৬শ গ্রাম। এতে ৫ ওয়াটের একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব আছে, বৈদ্যুতিক সংযোগ দিলেই ২০-৩০ মিনিটের মধ্যেই মশা নিধন শুরু হবে। ২ হাজার বর্গফুটের মধ্যে যত মশা থাকবে সব মশা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ যন্ত্রের ভেতর ঢুকে যাবে। এতে বিদ্যুৎ খরচ হবে মাত্র ৭ ওয়াট। আর পুরো যন্ত্রটির খরচ পড়বে মাত্র ২ হাজার টাকা।
অত্যাধুনিত যন্ত্রটির জনক আবদুল হামিদ বলেন, ২০১১ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে এ যন্ত্রটি আবিষ্কারে সমর্থ হই। ২০১৪ সালের জুন মাসেই শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট বিভাগে আবেদন করার পর বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জরিপ চালায়। দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস পর্যন্ত জরিপ চালিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে আবিষ্কৃত মশকিটো কিলার (মশা নিধক) এ যন্ত্রটির ন্যায় কোথাও কোনো যন্ত্রের সন্ধান না পাওয়ায় নতুন প্রযুক্তি হিসেবে এর অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সরকার। অনুমোদিত প্রযুক্তির পেটেন্ট নং-১৫০/২০১৪। এর মাধ্যমেই ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করেন যন্ত্রটির উদ্ভাবক মো. আবদুল হামিদ। যা স¤প্রতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গ্রেজেটে স্ব-বিস্তারে প্রকাশিত হয়েছে।
স্বয়ংক্রিয় আধুনিক এ যন্ত্রটির উদ্ভাবক মো. আবদুল হামিদ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে ১৯৮২ সালের ২ জুন জন্মগ্রহণ করেন। সাবেক এফডিসির কর্মকর্তা হাজী শামসুল হক ও গৃহিণী মাহমুদা খাতুনের পুত্র সে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আ. হামিদ চতুর্থ। গ্রামের বাড়ি হাওলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাওলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয় থেকে টেলিযোগাযোগ বিষয়ে ডিপ্লোমা করার পাশাপাশি জেনারেল এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখা অত্যাধুনিত যন্ত্রটির এ জনক অজপাড়াপাড়াগাঁয়ের ছেলে মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা করার পর অটোরিকশায় (বেটারিচালিত) বিদ্যুৎ সাশ্রয়সহ আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে গবেষণা করেছি এবং টেলিকমিউনিকেশন নিয়েও অনেক দিন গবেষণা করেছি কিন্তু এতে আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারায় ২০১১ সাল থেকে স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক ও পরিবেশবান্ধব মসকিটো কিলার (মশা নিধক) যন্ত্রটি নিয়ে গবেষণা শুরু করি। পর্যায়ক্রমে এ গবেষণায় মনোযোগী হলে প্রায় ৪ বছরের মাথায় এসে ২০১৪ সালের শুরুতে এর কাজ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে আরো দীর্ঘতর গবেষণার মধ্য দিয়ে এ প্রযুক্তিকে আধুনিক, দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব করেই বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করি। আমার এ দীর্ঘ গবেষণার কাজে লক্ষ লক্ষ টাকা, পরামর্শ, সাহস ও শক্তি জুগিয়েছেন আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ও বন্ধুরা।
এ ছাড়া আমার এ প্রযুক্তিকে বিশ্বে পরিচিতি ও বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি ও অনুমোদন নিতে পেটেন্টের জন্য উল্লেখযোগ্যহারে যারাই সহযোগিতা ও সাহায্য করেছেন সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জামাল আবদুন নাছের চৌধুরী এবং সাবেক বিভাগীয় কমিশনার (ভূমি) এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন স্যারের সহযোগিতায় আমার এ প্রযুক্তি মাতৃভূমি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। এ প্রযুক্তিবিদ আবদুল হামিদ বলেন, অত্যাধুনিক যন্ত্রটি বিশ্বজয়ের লক্ষ্যে প্রযুক্তির পেটেন্টটি ইতোমধ্যে চীন সরকারের কাছে জমা দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও ভারত, ব্রাজিল, ব্রিটিশ ও যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সঙ্গেও এ নিয়ে চলছে আলোচনা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা পেলে খুব কম সময়ের মধ্যে আবিষ্কৃত এ প্রযুক্তিটি বিশ্বজয়ে সমর্থ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অদম্য প্রতিভার অধিকারী বোয়ালখালীর মো. আবদুল হামিদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন