চালকের বেপরোয়া ওভারটেকিংয়ের শিকার বাসযাত্রী রাজিব হোসেনের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া হাতটি আমাদের চেতনায় যে বার্তা দিচ্ছে তা প্রকাশযোগ্য নয়। বেপরোয়া গাড়ীচালকদের অপরিনামদর্শি খামখেয়ালিতে তার মতো অঙ্গহানিসহ প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের জীবন রাজপথে ঝরে যাচ্ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে অসংখ্য পরিবারের স্বপ্ন, শান্তি ও স্বচ্ছলতা। যে শহরে বাসের গড় গতি পায়ে হাঁটার গতির প্রায় সমান, সেই শহরেই রাজিবের মত জীবন সংগ্রামী, সম্ভাবনাময় তরুণরা বাস চালকের বেপরোয়া প্রতিযোগিতার কারণে জীবন দিচ্ছে অথবা হাত-পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলছে গণপরিবহণের এই অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও মর্মান্তিক জীবনসংহারি ভ‚মিকা। এ থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় কি সরকারের হাতে নেই? উপায় নিশ্চয়ই আছে। অভাব শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও দায়িত্ববোধের। গণপরিবহণের বেপরোয়া প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিজের সহধর্মিনীকে হারিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের মত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বছরের পর বছর ধরে নিরাপদ সড়কের দাবীতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্ঘটনা রোধে একদিকে চালকদের দক্ষতা ও গাড়ীর ফিটনেস নিশ্চিতকরণ, ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ মোটা অংকের অর্থদন্ডের বিধান করার দাবী জানাচ্ছেন, পক্ষান্তরে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী বলছেন, মানুষ ও গরু-ছাপল চিনতে পারলেই চালকেরা লাইসেন্স পেতে পারে। মূলত দায়িত্বশীল মহলের দায়িত্বহীন আচরণের কারনেই সড়ক দুর্ঘটনা এবং গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছেনা।
গতবছর প্রকাশিত সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রির্সাচ বাংলাদেশ (সিআইপিআইবি)’র এক জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৪জন লোক মারা যায়, বাংলাদেশ হেল্থ ইনজুরি সার্ভে-২০১৬(বিএইচআইএস) শিরোনামের এই জরিপে দেখা গেছে, সব ধরনের দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যুর হারের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশী বলে উক্ত জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে। সড়কে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির হার প্রতি বছরই বাড়ছে। যে ভাবেই হিসাব করা হোক, একটি স্বপ্নময় জীবন এবং পঙ্গুত্ব নিয়ে স্বপ্নভঙ্গের মূল্য আর্থিক ক্ষতির মানদন্ডে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। সে দিন ঢাকায় কারওয়ান বাজারে বাস চালকের বেপরোয়া গাড়ী চালনায় বিআরটিসি বাসের সাথে ঘর্ষণে পিষ্ট হয়ে রাজিব হোসেনের হাতটি বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজপথে ছিটকে পড়ে, গড় হিসাবে সেদিনও সারাদেশে অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এসব মানুষের জীবন সংহারের সব গল্প প্রতিদিন সংবাদপত্রে উঠে আসেনা। ঢাকার যানজটে নাকাল রাজপথে অকালে পিতা-মাতা হারানো রাজিব হোসেন একটি পরিবারের টিকে থাকা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুকঠিন দায়িত্ব কাধে নিয়েছিল। একটি অফিসে কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করে নিজের ও ছোট দুই ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ যোগাচ্ছিল সে। যে হাতকে কম্পিটারের মাউস কীবোর্ডে ব্যস্ত রেখে জীবনের স্বপ্ন পুরনের লক্ষ্যে নিরলস ছিল সে হাতটিই সে হারিয়েছে। হাসপাতালের বেডে এখনো সে শংকামুক্ত নয়। বেপরোয়া বাসচালকের কারণে হাত হারানো রাজীব হোসেনের সব চিকিৎসা ব্যয় মিটানোর নির্দেশ এবং তাকে কেন এক কোটি টাকা ক্ষতিপুরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হবেনা তা জানতে চেয়ে দুই বাস মালিক পক্ষের প্রতি একটি রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। সংঘর্ষে ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দুই বাসের চালককে শাহবাগ থানার পুলিশ ইতিমধ্যে আটক করেছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অসংখ্য মৃত্যুর মিছিলে দুয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনা চাঞ্চল্যকর হয়ে দাড়ায়। গণমাধ্যমের সুবাদে নাগরিক সমাজে তোলপাড় সৃষ্টি করা এসব ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিছু লোক দেখানো তদন্ত ও ঘোষনা শোনা যায়। কখনো কখনো আদালতের পক্ষ থেকেও নির্দেশনা জারি করা হয়। ব্যাস এই পর্যন্তই। তদন্তের সুপারিশ বা আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের উপর তারা বেপরোয়া চালক ও মালিকদের অন্যায্য দাবীর পক্ষে তাদের কথা বলতে শোনা যায়। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর ইতিমধ্যে ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও দায়ী ব্যক্তিদের এমন কোন শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়নি যে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটানোর সাহস আর কেউ করবেনা। মামলার ৬ বছরের মাথায় আদালত তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪.৬১ কোটি টাকা ক্ষতিপুরণ দেয়ার নির্দেশ দিলেও এখনো সে নির্দেশ বাস্তবায়নের কোন খবর নেই। বেপরোয়া গাড়ী চালনার কারণে হতাহতের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তির দু’ চারটি দৃষ্টান্ত তৈরী হলে হয়তো দুর্ঘটনার হার অনেক কমিয়ে আনা যেত। যেখানে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাসচালকদের কঠোর শাস্তির বিধানের পাশাপাশি বাস মালিকদের উপর মোটা অংকের ক্ষতিপরণের আইন করার দাবী করা হচ্ছে, সেখানে সম্প্রতি প্রণীত খসড়া আইনে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকের সর্বোচ্চ ৩ বছরের সাজা, ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনের এ পরিবর্তনে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আন্দোলনকারিদের দাবীগুলোকে অগ্রাহ্য করে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবীকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারের প্রভাবশালী মহল জনগণের নিরাপত্তার চেয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় বেশী তৎপর থাকার কারণেই গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছেনা। বছরে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ হরণ, হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির জন্য দায়ী পরিবহণ চালক ও মালিকদের প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের অনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বন্ধ করতে হবে। গণপরিবহনে চাঁদাবাজি ও যাত্রী হয়রানি বন্ধ করতে হবে। যাত্রী ও পথচারীদের সচেতনতা এবং দায়ী চালক-মালিকদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন