শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সকল ফিচার

টেক্সটবুক থেকে ফেসবুকে!

তারিক ইমন | প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০১৮, ৮:৫৩ পিএম

কিশোর ও তরুণ সমাজের সারাদিনের সময়ের বড় একটা অংশ দখল করে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। একটা সময় ছিল যখন হাতে সবসময় একটা বই থাকত, বাসে ভ্রমণ অবস্থায় কিংবা একটু অবসর পেলেই চোখ পড়ে থাকত সেই বইয়ের পৃষ্ঠায়। দুপুরে খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রামের জন্যে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে হাতে নেয়া হত হুমায়ূন আহমেদ, শীর্ষেন্দু, সুনীলের উপন্যাস কিংবা তারও আগের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বিভূতি ভূষণের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিকদের বই, অথবা একটি সাধারণ জ্ঞানের বই। সেটিতে চোখ বুলাতে বুলাতেই ঘুম চলে আসতো। কিন্তু এখন সেই বইয়ের যায়গাটি দখল করে নিয়েছে একটি স্মার্টফোন। আর সেই ফোন হাতে নিয়েই ঢুকে পড়ে ফেসবুক নামক বিশাল নীল সাদার জগতে।

ফেসবুকের কারণে অনেকে রাতের ঘুমকে বিসর্জন দিচ্ছে। রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছে ভার্চুয়াল জগতে। মনিরুল ইসলাম নামে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী ইনকিলাবকে বলেন, আমি যখন মেট্রিক বা ইন্টারে পড়তাম তখন সন্ধ্যাটা পার হলেই চোখে ঘুম চলে আসতো। পড়ালেখার খুব চাপ থাকলে হয়তো সর্বোচ্চ রাত ১২ টা পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। কিন্তু কয়েকবছর যাবত রাত ১২টার দিকে কবে যে ঘুমিয়েছি তা মনে পড়ছে না। প্রতিদিন ফেসবুক চালাতে বা ইউটিউবে ভিডিও দেখতে দেখতে রাত ২-৩টা বাজে। ২টার আগে তো একদিনও ঘুমাতে পারি না। আসলে ২ টার আগে ঘুমই আসে না চোখে। ফজলে কবির নামে আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমরা যারা ফেসবুক ব্যবহার করি, কোনো না কোনো ভাবে এটা আমাদের ক্ষতি সাধন করে। আমি নিজেই যখনি সময় পাই তখনি ফেসবুকে পড়ে থাকি। অনেক সময় দেখা যায় ফেসবুকে এতটাই মগ্ন থাকি যে সকালের নাস্তা করতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়। রাতে ঘুমানোর আগে ঢুকলে ১টা, ২টা ছাড়া বের হওয়া যায় না, যার ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়। আমাদের অজান্তেই এর প্রতিক্রিয়া কোনো না কোনো ভাবে আমাদের শরীর, পড়ালেখা, পরিবার, দৈনন্দিন কাজকর্মসহ অনেক কিছুতেই বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

বিশ্লেকষরা বলছেন, তথ্য প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমের ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। তবে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে পাঠ্য বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ইনকিলাবকে বলেন, তরুণ প্রজন্ম ফেসবুক ব্যবহার করবে এটা খুবই স্বাভাবিক। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তারা তাদের আকাঙ্ক্ষা চাহিদা পূরণ করে সেটা আমরাও প্রত্যাশা করি। তবে সেটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির সৎব্যবহারের প্রতি সচেতন থাকতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ফেসবুক ব্যবহারে সাধারণ জ্ঞান বা পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়নের উপর কিছুটা প্রভাব পড়ছে। আসলে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের কোনো বিকল্প নেই। তবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেও অধ্যয়ন করা যায়। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে বই পাঠের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়ন ছাড়া একটা মানুষ তার মনুষ্যত্বকে বিকশিত করতে পারে না।

শুধু তরুণ সমাজই নয়, প্রযুক্তির অপব্যবহার কেড়ে নিচ্ছে শিশু-কিশোরদের প্রকৃত শৈশব-কৈশোর। দুরন্তপনার এই বয়সে যখন তাদের দৌড়ঝাঁপ আর মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করার কথা তখন তাদের কাছে খেলাধুলা আর বিনোদন মানেই হচ্ছে সারাক্ষণ স্ক্রিনে চোখ মগ্ন হয়ে থাকা। যুক্তরাজ্যে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৩-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করে ভিডিও গেমস, কম্পিউটার, ই-রিডার্স, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য স্ক্রিনভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পেছনে। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। গত বছর ৩১ ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান মতে, মাসে অন্তত একবার ফেসবুক ব্যবহার করেন এমন লোকের সংখ্যা ২.১৩ বিলিয়ন। গত বছর এপ্রিলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আড়াই কোটি। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে একটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ঢাকা। ফেসবুক, ভায়োলেন্স এন্ড সেইফটি অফ চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ নামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে আট বছর বয়সের শিশুরাও ফেসবুক ব্যবহার করছে। গবেষণা জরিপে অংশগ্রহনকারী ১৪ শতাংশ শিশু স্বীকার করেছে তারা ১৩ বছরের কম বয়সী হলেও নিয়ম অমান্য করে ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছে।

ফেসবুকের অতিরিক্ত ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির কথা বলছেন চিকিৎসকরা। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আহসান সাব্বির ইনকিলাবকে জানান, অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহারে মানসিক সমস্যা হচ্ছে, এটা মনকে কন্সেনট্রেট করতে পারে না, কোনো কাজের সময় ফেসবুক নিয়ে চিন্তার ফলে চিন্তার একমুখীতা নষ্ট করে। অনেকসময় অতিমাত্রায় ফেসবুক ব্যবহারে ডিপ্রেশন দেখা দেয়। ফেসবুকে অন্য মানুষের সাফল্য দেখে হীনমন্যতায় ভোগা যা ফ্রাস্ট্রেশনের জন্ম দেয়। রাত জেগে ফেসবুকিং করার কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। যার ফলে ফলে স্মৃতি শক্তি কমে যায়, ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া, কানের সমস্যা হচ্ছে। একটানা মনিটরের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। ঘাড়ের ব্যথা, কোমর ব্যথা হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, মানুষ আগে শারীরিক খেলাধুলার মাধ্যমে যে প্রাকৃতিক বিনোদন উপভোগ করতো, এটার যায়গায় অনেকে ফেসবুকে বেশি সময় দেওয়ার কারণে অতি ওজন, ডায়াবেটিস, হার্টের করোনারি আর্টারি ডিজিজ ইত্যাদি সমস্যা হচ্ছে। অনেকের ফিজিক্যাল ফিটনেস কমে যাচ্ছে।

ফেসবুকসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের কথা জানালেন প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার । তিনি বলেন, আধুনিক বিশ্বের সাথে চলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। তবে শুধু ফেসবুকই নয়, ইন্টারনেটের যে কোনো অপব্যবহার রোধ করতে আমরা বদ্ধ পরিকর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন