ইংল্যান্ড : ১৫৫/৯ (২০.০ ওভারে)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ১৬১/৬ (১৯.৪ ওভারে)
ফল : ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে জয়ী।
শামীম চৌধুরী : শেষ ওভারে ১৯, এমন টার্গেটের মুখে দাঁড়িয়ে উইন্ডিজ সমর্থকরা তো দূরের কথা, ডাগ আউটে বিষণœ উইন্ডিজ কোচ ফিল সিমন্স, অধিনায়ক ড্যারেন স্যামীর চোখে-মুখেও বিষণœতার ছাপ। এমন পরিস্থিতিতে উইন্ডিজের পক্ষে বাজি ধরাটাই যে বোকামি। অথচ, যে ছেলেটির ইতোপূর্বে ৪ ইনিংসে সর্বসাকূল্যে সংগ্রহ ২৫ রান, সেই কার্লস ব্রাফেটই গেইল হয়ে হাজির ইডেন গার্ডেনসে! ২০তম ওভারে বেন স্ট্রোকসের প্রথম বলকে ফাইন লেগের উপর দিয়ে ছক্কায় নড়েচড়ে উঠল ইডেন গার্ডেনস, পরের বলে লং অনের উপর দিয়ে গ্যালারিতে আছড়ে ফেললেন বল! তৃতীয় বলটিকে লং অফের উপর দিয়ে সীমানা ছাড়া করার সঙ্গে সঙ্গে ডাগ আউট থেকে একযোগে বাউন্ডারি রোপের সামনে উঠে এলো পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। ৪র্থ বলকে মিড উইকেটের উপর দিয়ে ব্রাফেটের ছক্কার সঙ্গে সঙ্গে সে কি দৌড়, এক একজন যেনো ১০০ মিটার স্প্রিন্টে উসাইন বোল্ট, ইউহান ব্লেক, আসাফা পাওয়েল! ২ বল হাতে রেখে ৪ উইকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রোমাঞ্চকর জয়! ভারতের বৃহত্তম ক্রিকেট ভেন্যু কোলকাতার ইডেন গার্ডেনসে ৬৭ হাজার দর্শক সাক্ষী হয়ে রইল এমন জয়ের।
উইন্ডিজ মেয়েদের প্রথম টি-২০ শিরোপা জয়ে স্টিফানো টেলরদের সঙ্গে নেচেছিলেন ড্যারেন স্যামী, ডুয়াইন ব্রাভোরা। মেয়েদের ওই জয় থেকে প্রেরণা নিয়ে ট্রফি হাতে ইডেনের রাতটা আরও রঙিন করে তুলল উইন্ডিজ ক্রিকেট দল। ২০১২ সালে কলম্বোর প্রেমাদাসায় স্বাগতিকদের কাঁদিয়ে গ্যাংন্যাম নৃত্যে ক্রিকেট আনন্দে দিয়েছে স্যামীরা নুতন মাত্রা, শিরোপা পুনরুদ্ধারের সঙ্গে প্রথম কোনো দল হিসেবে দ্বিতীয়বার টি-২০ বিশ্বকাপের ট্রফি জয়ের আনন্দে তাদের নৃত্যের নাম হয়ে থাকলো চ্যাম্পিয়ন ড্যান্স। গ্যাংনাম নৃত্যে পায়ের কাজটা বেশি, চ্যাম্পিয়ন ড্যান্সে সেখানে কাজটা বেশি হাতের! ঢাকায় গত ফেব্রুয়ারিতে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ট্রফি জয় থেকে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের স্বর্ণালী অতীত ফিরে পাওয়ার গল্প শুরু। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পর টি-২০ বিশ্বকাপে উইন্ডিজ ছেলে এবং মেয়েদের শিরোপা জয়-মাত্র ২ মাসের মধ্যে আইসিসি’র ঊপর্যুপরি তিনটি মেগা টুর্নামেন্টের সব ক’টির শিরোপা উইন্ডিজের। যে গল্প হার মানাবে রূপকথাকেও।
টস থেকে শুরু করে সবকিছুই পক্ষ নিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। চলমান টি-২০ বিশ্বকাপে টস ভাগ্যটা শতভাগ থাকল স্যামীর পক্ষে। ৬ ম্যাচের সব ক’টিতেই টসে জয়, আগের ৫টি ম্যাচের মতো ফাইনালেও টসে’র সিদ্ধান্ত চেজিং! ইংল্যান্ডের কাছে টি-২০ বিশ্বকাপে কখনো হারের রেকর্ড ছিল না ইতোপূর্বে, সেই রেকর্ডটাও থাকলো অটুট। ১৯৭৯ বিশ্বকাপ এবং ২০০৪ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ইংল্যান্ডের মাটিতে হতাশায় ডুবিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, টি-২০ বিশ্বকাপের শিরোপা পুনরুদ্ধার ফাইনালেও সেই ইংল্যান্ডকে হতাশায় পোড়ালো স্যামীর দল। দলের সঙ্গে থেকে প্রেরণা জুগিয়ে যাওয়া সাবেক অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের সঙ্গে আইসিসি’র মেগা আসরে ২টি করে ট্রফি উইন্ডিজকে উপহার দেওয়ার ইতিহাসটাও যে রচনা করলো অধিনায়ক ড্যারেন স্যামী।
ফাইনালটা হয়েছে ফাইনালের মতোই। ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে জেসন রয়, হেলসকে হারিয়ে ইংল্যান্ডের ৩৩/৩ স্কোরের জবাবে পাওয়ার প্লেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ৩৭/৩! প্রথম ৬ ওভার শেষ হওয়ার আগে নেই চার্লস, গেইল! ইংল্যান্ডের ইনিংসটা ৩৩/৩ থেকে ১৫৫/৯ পর্যন্ত টেনে নিয়েছেন জো রুট (৫৪), বাটলার (৩৬), উইলি (২১)। ৪র্থ জুটির ৪০ বলে ৬১ রানে সম্ভব হয়েছে এই চ্যালেঞ্জিং স্কোর। সেখানে শুরুর ধাক্কা সামাল দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজও ম্যাচে ফিরেছে স্যামুলেলস (৮৫ নট আউট), ব্রাভো (২৫) এবং কার্লস ব্রাফেট (৩৪ নট আউট)-এই ত্রয়ীর পারফর্মেন্সে। শেষ ৬০ বলে অবিশ্বাস্য ১০২, শেষ ৩০ বলে ৫২’র টার্গেটটা পাড়ি দিতে পেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ চতুর্থ জুটির ৬৯ বলে ৭৫ রানে।
ভাগ্যটাও পক্ষ নিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের। প্লাঙ্কেটের বলে ২৭ রানের মাথায় বাটলারকে ক্যাচ দিয়ে নিজেই ফিরেছিলেন স্যামুয়েলস ড্রেসিংরুমের দিকে। টিভি আম্পায়ার পর্যন্ত সিদ্ধান্তটি গড়ানোয় ইংলিশ উইকেট কিপারের জুচ্চরিটা ধরা পড়ায় ফিরে পেয়েছেন জীবন স্যামুয়েলস। বেঁচে যাওয়া সেই স্যামুয়েলসই ফাইনাল হিরো (৬৬ বলে ৯ চার ২ ছক্কায় নট আউট ৮৫)। ১১ রানের মাথায় স্ট্রোকসের বলে ডিপ স্কোয়ার লেগে ক্যাচ দিয়ে বিলিংসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ব্রাভো ইনিংস টেনে নিয়েছেন ২৫ বলে।
ত্রিনিদাদ থেকে উড়িয়ে আনা সিমন্স ৮২ রানের ইনিংসে মুম্বাইয়ে কাঁদিয়েছেন ভারতকে। গতকাল ইংল্যান্ডকে কাঁদিয়েছেন কার্লস ব্রাফেট নামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আনকোরা এক অল রাউন্ডার। ইংল্যান্ড ইনিংসে এই উইন্ডিজ পেসারই বড় ধরনের ধাক্কা দিতে পেরেছেন। ইতোপূর্বের ৭ ম্যাচে উইকেট সংখ্যার সমষ্টি যার মাত্র ২টি, চলমান টি-২০ বিশ্বকাপে ইতোপূর্বের তিন ম্যাচে উইকেটহীন এই ব্রাফেটই কি না গতকাল করেছেন ক্যারিয়ার সেরা বোলিং (৪-০-২৩-৩ )! বাটলারের পর মূল্যবান শিকার তার জো রুট। ব্যাটিংয়ে তো রীতিমতো বিস্ময় ছড়িয়েছেন এই লোয়ার অর্ডার। ইতোপূর্বে ৪ ইনিংসে যার সর্বসাকূল্যে সংগ্রহ মাত্র ২৫, সেই ছেলেটিই খেলেছেন ম্যাচ উইনিং ইনিংস (১০ বলে ১ চার ৪ ছক্কায় হার না মানা ৩৪)! দ্য ফিনিশার চরিত্রে আবির্ভূত গেইলের ক্লোন।
ইংল্যান্ড যেখানে ৪৫ বল করেছে ডট, সেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডট বলের সংখ্যা ৫২। পাল্লাটা ভালোই হয়েছে বাউন্ডারিতে-ইংল্যান্ডের ১২টি চারের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাউন্ডারির সংখ্যাও সেই ১২টি। পার্থক্য কেবল ছক্কার সংখ্যায়-ইংল্যান্ডের ৫টির বিপরীতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৭টি! লেগ স্পিনার স্যামুয়েল বাদরির (২/১৬) সঙ্গে নতুন বলে ইংল্যান্ডের পেস বোলার উইলির লড়াইটাও (৩/২০) হয়েছে ভালো। বাদরির ১৪টি ডট বলের বিপরীতে উইলির ডট ১৩টি। বাদরির প্রথম স্পেলটি ৩-১-৮-২, সেখানে উইলির ২-০-৩-১! তবে বোলিং লাইন আপে পার্থক্য গড়েছেন উইন্ডিজ পেসার কার্লস ব্রাফেট (৩/২৩)। তিন নম্বরে জো রুটের (৩৬ বলে বলে ৭ বাউন্ডারিতে ৫৪) ইনিংসকে ম্লান করেছেন গেইলের বন্ধু স্যামুয়েলস। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত টি-২০ বিশ্বকাপে ট্রফি জয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাইনাল হিরো (৫৬ বলে ৭৮) উইন্ডিজের শিরোপা পুনরুদ্ধার ইতিহাসের ফাইনাল ম্যাচেও হিরো (৬৬ বলে ৯ চার ২ ছক্কায় ৮৫ নট আউট)। ২০১২ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা নট আউট ৮৫ রানের ইনিংস স্পর্শ করেই থেমেছেন ফাইনাল হিরো। টি-২০’র বিনোদন খ্যাতি পেয়েও গেইল যা পারেননি, তা পেরেছেন দু’দুবার। ২০১২ টি-২০ বিশ্বকাপে ৩ রানে ফিরে দলকে ফেলেছিলেন বিপদে গেইল, সেই ম্যাচে ৭৮ রানের ম্যাচ উইনিং ইনিংসে হাসিয়েছেন দলকে স্যামুয়েলস। ৪ বছর পর টি-২০ বিশ্বকাপের ট্রফি নির্ধারণী ম্যাচেও গেইল ফ্লপ (৪), বন্ধুর দায়িত্বটা পালন করেছেন সময়োচিত ইনিংসে (৮৫ নট আউট)। জানেন, ২টি ফাইনালেই ফাইনাল সেরার পুরস্কার পেলেন স্যামুয়েলস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন