সরকারী চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বুধবার সংসদের বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সরকারী নিয়োগে কোটা বাতিলের ঘোষনা দেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা কোটা সংস্কারের দাবী জানিয়ে আসলেও সরকারের তরফ থেকে তাদের যৌক্তিক দাবী কখনো আমলে নেয়া হয়নি। গত সপ্তাহের শুরুতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে রাস্তায় নেমে আসে। তাদের লাগাতার অবস্থান ও আন্দোলন ক্রমে তীব্র হয়ে ওঠে এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সংহতি ও অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে তা ব্যাপক আন্দোলনে রূপ লাভ করে। এহেন বাস্তবতায় সরকারের পক্ষ থেকে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব আমলে নিয়ে পরিষদের প্রতিনিধিদের সাথে আওয়ামিলীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের একটি সমঝোতা হয়। আগামী ৭ মের মধ্যে কোটা পূর্নমূল্যায়ণের আশ্বাস দেয়া হয়। এই সমঝোতা নিয়ে আন্দোলনকারীরা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেলেও বৃহত্তর ছাত্র সমাজ সরকারের এই প্রস্তাব কার্যত মেনেই নিয়েছিল। তবে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বক্তব্য ছিল সরকারের প্রতিশ্রæতি ও সমঝোতার সাথে সাংঘর্ষিক। এমনিতেই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ক্যাম্পাসে ও রাজপথে সক্রিয় ছিল, মন্ত্রীদের অনভিপ্রেত বক্তব্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পুনরায় ঐকবদ্ধ হয়ে মাঠে নামতে বাধ্য করে।
প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত ঘোষনার মধ্য দিয়ে দেশ একটি সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা ও অচলাবস্থা থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পুরো কোটাব্যবস্থাই বাতিলের ঘোষণা দিলেও শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের দাবী ছিল কোটা বাতিল নয়, তা সংস্কার করে সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের সরকারী চাকরিতে নিয়োগের পথ সুগম ও প্রস্বস্ত করা। এই মুহূর্তে শিক্ষার্থী ও সর্বসাধারণের দাবী হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা যথাশীঘ্র বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ ব্যাপারে সময় ক্ষেপন ও গড়িমসি হলে পুনরায় আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে। সরকার শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের দাবী মেনে নেয়ার আগে এই দাবী আদায়ে তাদের আন্দোলন করতে হয়েছে। সে আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি কোথাও কোথাও ছাত্রলীগকেও মারমুখী ভ‚মিকা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। সর্বোপরি মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির বাসভবনে ন্যক্কারজনক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। প্রশিক্ষিত ও পেশাদার সন্ত্রাসীরাই ভিসির বাসায় হামলার ঘটনায় জড়িত বলে অনেকেই মনে করছেন। হামলার সাথে যারাই জড়িত থাক তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আন্দোলনের সময় বেশকিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী আহত এবং পুলিশের হাতে আটক হয়েছে। যেহেতু আন্দোলন ও দাবী-দাওয়া এখন মিমাংসিত ইস্যু, অতএব মামলা প্রত্যাহার, আহতদের চিকিৎসা ও আটকদের মুক্তি দেয়াই হবে সঙ্গত।
শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের যৌক্তিক দাবীর প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষনাকে যে যেভাবেই গ্রহণ করুক, এ ধরনের সিদ্ধান্তকে কোন রাজনৈতিক মোড়ক দেয়া কাঙ্খিত নয়। তবে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে রাজনৈতিক ব্রান্ডিংয়ের চেষ্টা করা অস্বাভাবিকও নয়। প্রতিটি জাতীয়-রাজনৈতিক সংকটে আমাদের দেশের ছাত্র সমাজের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভ‚মিকা রয়েছে। বিগত এক-এগারো সরকারের সময়ও ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদেরকে হঠাৎ ফুসে উঠতে দেখা গেছে। প্রায় তিন দশক ধরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ না থাকায় সমাজের নিয়মতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতি এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। তবে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আন্দোলনটি ছিল শান্তিপূর্ণ ও অহিংস। প্রায় সবগুলো ছাত্রসংগঠনের কর্মীসমর্থকরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। সাধারণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও অরাজনৈতিক হওয়ার কারণেই সরকার দ্রæত দাবি পুরণে সম্মত হয়েছে। কোটা বাতিলের ঘোষনা দিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাটিও ছিল অত্যন্ত সংযত ও সৌজন্যপূর্ণ। তিনি দাবির যৌক্তিকতা এবং দাবির প্রতি দেশব্যাপী গণসমর্থনের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। এজন্য আন্দোলনকারীরা তার প্রতি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমরাও তাকে ধন্যবাদ জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন