‘ত্রিফলা’ অতি চমৎকার এক ভেষজ মিশ্রণ, যা অসংখ্য রোগ নিরাময়ে আয়ুর্বেদ চিকিৎসকেরা ব্যবহার করে থাকেন। রেচক বা জোলাপ হিসেবে এর ব্যবহার হলেও, অসংখ্য রোগ নিরাময়ে এর রয়েছে বিশাল ভ‚মিকা। আজ বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের ্র দিনেও ত্রিফলার রোগ নিরাময়ি ভ‚মিকা পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। তাই অনেক বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও গবেষকের কাছে ত্রিফলা এক অত্যাশ্চর্য ভেষজ মিশ্রণ। শুধু রেচক হিসেবে নয়, উদ্দীপক ও শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে এর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। ত্রিফলা আমাদের শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়, রক্ত পরিষ্কার করে, আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পুনঃযৌবন দান করে এবং আমাদের দেহকে নবীন ও শক্তিশালী করে।
সংক্ষিপ্ত পরিচিত: ‘ত্রিফলা’ কথাটির মানে হচ্ছে তিন ফলের সমাহার বা মিশ্রণ। আর এই ফল তিনটি হলো- আমলকী, হরীতকী ও বহেড়া। দ্রব্যগুণে ফল তিনটির অবস্থান অনেক ঊর্ধ্বে। শুধু আয়ুুর্বেদ শাস্ত্রে নয়, আধুনিক গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে যে, দ্রব্যগুণে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে হরীতকী, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমলকী এবং তৃতীয় স’ানে বহেড়া। ফল তিনটির বীজ বাদে বাকি অংশ শুকিয়ে গুড়ো করে সমপরিমাণে মিশিয়ে ত্রিফলা তৈরি করা হয়।
আয়ুর্বেদ রসায়নে ‘ত্রিফলা’: আয়ুুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মানবদেহ তিনটি মূল বা সারবস্তুর সমন্বয়ে গঠিত। এই সারবস্তু তিনটি হলো বাতা (Vata), পিত্ত (Pitta) ও কাফা (Kapha)। ‘বাতা যার বাংলা মানে হচ্ছে বায়ু, যা আমাদের মন ও স্নায়ুতন্ত্রের সাথে জড়িত। এর স্বভাব বা প্রকৃতি হচ্ছে শুষ্ক, ঠান্ডা, হালকা ও শক্তিশালী। দ্বিতীয়টি হলো ‘পিত্ত’ যার বাংলা মানে হচ্ছে অগ্নি। এটি আমাদের বিপাকক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত, যা আমাদের দেহে যাবতীয় খাদ্যের হজমক্রিয়ায় জড়িত। শেষের ‘কাফা’ যার মানে হলো পানি বা শ্লেষ্মা। অনেক সময় পানি বা শ্লেষ্মাকে জীবনের মূল ভিত্তি বলা হয়। এটি আমাদের দেহের সব গঠনক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এটি আমাদের দেহের নিত্যনতুন কোষ তৈরি, মাংসপেশির গঠন, হাড়ের গঠন ও বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। এর প্রকৃতি বা স্বভাব হলো ঠান্ডা, আর্দ্র ও ভারী।
এই বাতা, পিত্ত ও কাফার সমন্বয়ে আমাদের দেহ গঠিত বলে এগুলোর যেকোনো একটির ভারসাম্যহীনতা বা অস্বাভাবিকতা আমাদের দেহে বিভিন্ন প্রকারের রোগ সৃষ্টি করে। আর ত্রিফলাতে রয়েছে এই সারবস’গুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কার্যকর উপাদান। এ তিন সারবস্তুর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে বলে একে বলা হয় ত্রিদোষনাশক। ত্রিফলার (আমলকী, হরীতকী ও বহেড়া) প্রতিটি ফলের ত্রিদোষনাশক গুণাবলি থাকলেও এর একেকটি ফল একেকটি সারবস্তুর (বাতা, পিত্ত ও কাফা) ভারসাম্য রক্ষায় বেশি কার্যকর। কোন ফলটি কোন ভারসাম্য রক্ষায় বেশি কার্যকর তা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
হরীতকী: এ ফলটি তিক্ত স্বাদযুক্ত যা আমাদের ‘বাতা’ নামক সারবস্তু তথা মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই মস্তিষ্ক ও স্নায়ুবিক কোনো রোগে হরীতকী খুবই কার্যকর। হরীতকী রেচক, সঙ্কোচক, পিচ্ছিলকারক, পরজীবীনাশক, মাংসপেশির সঙ্কোচক প্রতিরোধক এবং স্নায়ুবিক দুর্বলতা প্রতিরোধী গুণসম্পন্ন। তাই দীর্ঘকালীন কোষ্ঠকাঠিন্য, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, উদ্বিগ্নতা এবং অল্পতেই হƒদকম্পন বেড়ে যাওয়ার চিকিৎসায় হরীতকী ব্যবহƒত হয়। ত্রিফলার তিনটি ফলের মধ্যে হরীতকী সর্বশ্রেষ্ঠ রেচক এবং দ্রব্যগুণেও সর্বশ্রেষ্ঠ।
আমলকী: আমলকী অম্ল বা টকস্বাদযুক্ত যা পিত্ত নামক সারবস্তুর ভারসাম্য রক্ষায় খুবই কার্যকর। এটি ঠান্ডাকারক, সঙ্কোচক, মৃদু বিরেচক গুণসম্পন্ন তাই আমাদের বিপাক জনিত বিভিন্ন সমস্যা যেমন- আলসার, পাকস’লীর প্রদাহ, আন্ত্রিক প্রদাহ, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, কলিজা বা লিভারের জ্বালাপোড়া, যকৃতের সংক্রামণ এবং শরীরের জ্বালাপোড়া নিরাময়ে আমলকী খুবই কার্যকর। আধুনিক কালের অসংখ্য গবেষণায় আমলকীর ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রতিরোধী, কফ নিঃসারক এবং হৃৎপিন্ডের টনিক গুণাবলির প্রমাণ পাওয়া যায়। আমলকী ভিটামিন-সি রয়েছে এবং এর ভিটামিন-সি তাপে নষ্ট হয় না। এমনকি অতি উচ্চ তাপেও এর ভিটামিন-সি নষ্ট হয় না। তাই আমলকীর পুষ্টি ও ঔষধিগুণ অপরিবর্তিত রেখে শুকিয়ে এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। আমলকীর ভিটামিন-সি দীর্ঘস্থায়ী ও তাপ সহ্যকারী হওয়ার মূল কারণ হলো এতে বিদ্যমান ট্যানিন ভিটামিন-সির সাথে বন্ধন তৈরি করে এবং এর ক্রমাগত হ্রাস বা ধ্বংস হওয়া প্রতিরোধ করে।
বহেড়া: বহেড়া কষায় স্বাদযুক্ত ফল। এটি ‘কাফা’ নামক সারবস’র ভারসাম্য রক্ষায় খুবই কার্যকর। বহেড়া সঙ্কোচক, টনিক, হজমশক্তির বৃদ্ধিকারক এবং মাংসপেশির সঙ্কোচন প্রতিরোধক গুণসম্পন্ন। বহেড়া দেহের প্রধান জীবনীশক্তি শ্লেষ্মা তথা রসকে বিশুদ্ধ করে এবং এর ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই বহেড়া হাঁপানি, অ্যালার্জি, ব্রঙ্কাইটিস ও কাশির ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর।
ত্রিফলার কিছু গুণ: ১. হজমশক্তি বৃদ্ধি করে ২. অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে ৩. দেহে রক্তসঞ্চালন বাড়ায় ৪. রক্তচাপ কমায় ৫. হৃদরোগ কমায় ৬. রক্তে কোলেস্টেরল কমায় ৭. যকৃৎ বা লিভারের রোগপ্রতিরোধ করে ৮. লিভারের পিত্ত নিঃসরণ বাড়ায় ৯. কফ নিঃসরণ করে ১০. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে ১১. ওজন হ্রাস করে ১২. ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে ১৩. এইডস প্রতিরোধ করে প্রভৃতি।
ত্রিফলা কিভাবে কাজ করে: ত্রিফলা এক অতি চমৎকার ভেষজ মিশ্রণ, যা আমাদের শরীরের সব অঙ্গপত্যঙ্গের ওপর উপকারী ও কার্যকর ভ‚মিকা পালন করে। নিম্ন বিভিন্ন তন্ত্রের ওপর এর কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করা হলো।
বাহ্যিক ব্যবহারে: ত্রিফলা চ‚র্ণ চোখের জন্য খুবই উপকারী। ত্রিফলা দৃষ্টিশক্তি বাড়ায় এবং চোখের অনেক রোগ দূর করে। ত্রিফলা ঘৃত, এক আয়ুর্বেদি ওষুধ যা চোখের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে। চোখের রোগের চিকিৎসায় ত্রিফলার কাথ খুবই কার্যকর। এ ছাড়া ত্রিফলার পেস্ট ক্ষত নিরাময় এবং ফেলা কমাতে খুবই কার্যকর।
স্নায়ুতন্ত্রের ভারসাম্যতায়: আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর রয়েছে ত্রিফলার বিশাল উপকারী ভ‚মিকা। ত্রিফলা আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়। ফলে মস্তিষ্ক দ্রæত কোনো কাজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে, যেকোনো স্নায়ুবিক রোগই বাতা নামক সারবস্তুর ভারসাম্যহীনতার ফলে হয়। ত্রিফলা শুধু বাতা নয়, পিত্ত ও কাফা অর্থাৎ তিনটির ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। তাই মস্তিষ্ক ও স্নায়ু সম্পর্কিত যেকোনো রোগ নিরাময়ে ত্রিফলা খুবই উপকারী ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
পরিপাকতন্ত্রে: হজমশক্তি বৃদ্ধিতে ত্রিফলা খুবই কার্যকর। এটি শুধু হজমশক্তি বৃদ্ধি করে না বরং খাদ্যের উপাদানগুলোর শোষণেও সহায়তা করে। এটি পৌষ্টিক নালীর সঙ্কোচন প্রসারণ স্বাভাবিক রাখে। এটি যকৃৎ থেকে পিত্ত নিঃসরণসহ অন্যান্য অঙ্গের পাচক রস নিঃসরণ বাড়ায়। এটি পাকস্থলীর অম্লীয় ও ক্ষারীয় অবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হজমশক্তি বৃদ্ধি করে এবং সঠিক হজমক্রিয়া পরিচালনা করে। এটি ক্ষুধামান্দ্য দূর করে এবং আমাদের মাঝে আহার করার প্রবণতা সৃষ্টি করে। এটি আমাদের অন্ত্রের সঙ্কোচন প্রসারণ বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। সর্বোপরি এটি আমাদের পাকস্থলীর মসৃণ পেশির টান বা সঙ্কোচন প্রতিরোধ করে এবং এর স্বাভাবিক কার্যাবলি সাধনে সাহায্য করে।
প্রজননতন্ত্রে: প্রজননতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে ত্রিফলা খুবই উপকারী। এটি প্রজনন অঙ্গগুলোর ঢ়ঐ লেভেল নিয়ন্ত্রণ করে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের প্রজনন অঙ্গকে শক্তিশালী করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ত্রিফলা পুরুষের শুক্রাণু বৃদ্ধি করে এবং মহিলাদের মাসিক চক্র নিয়মিত করে। তাই প্রজননতন্ত্রের সমস্যায় ত্রিফলার ব্যবহার খুবই ফলপ্রসূ। চামড়া সজীব রাখতে- এটি আমাদের চামড়ার স্বাভাবিক গঠন নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষা করতে পারে। ত্রিফলা দেহে রক্তসঞ্চালন বাড়ায় ফলে চামড়া পরিপূর্ণ পুষ্টি পায়। অপর দিকে বেশি রক্তসঞ্চালন হওয়ায় চামড়ার মৃত কোষগুলোর অপসারণ হয়। ত্রিফলা বয়সের ফলে চামড়ার ভাঁজ ও চুল সাদা হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে। ত্রিফলা দেহে রক্ত ও পানির সুসামঞ্জস্য রক্ষা করে, ফলে ত্বক উজ্জ্বল ও আর্দ্র থাকে এবং বয়সের ছাপ পড়ে না।
-ডা. আলমগীর মতি
হারবাল গবেষক ও চিকিৎসক
চেয়ারম্যান মডার্ণ হারবাল গ্রুপ
ফোন ০১৯১১৩৮৬৬১৭
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন