টঙ্গী রেলওয়ে জংশনের অদূরে গত রোববার ঢাকাগামী ‘জামালপুর কমিউটার’ ট্রেনের ৫টি বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় কয়েকজন যাত্রী নিহত ও অর্ধশত আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। যাত্রীরা প্রাণ বাঁচাতে ট্রেনের ছাদ ও ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ে। এ কারণেই ওই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। কী কারণে এই দুর্ঘটনা, তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। এব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেনি। ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেশন মাস্টার ও সংকেত ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অবহেলায় ঘটেছে। খবরে জানানো হয়েছে, এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যাওয়ার সময় বিকট শব্দে বগি ৫টি লাইনচ্যুত হয়। গত শনিবার রাতে ওই একই স্থানে ‘তিতাস কমিউটার’ ট্রেন একইভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। রেলওয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশিত অপর এক খবরে বলা হয়েছে, টঙ্গী রেলস্টেশন এবং এর আগে-পরে সংকেত ব্যবস্থা পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় উপায়ে পরিচালিত হয়। এই ব্যবস্থায় পয়েন্টসে কোনো ত্রুটি থাকলে ট্রেন চলার সংকেতই হবে না। অর্থাৎ ট্রেনচলাচল সম্ভবই হবে না। সে ক্ষেত্রে লোক দিয়ে পয়েন্টস ও সংকেত নিশ্চিত করে ট্রেন চালানো হয়। রোববার ম্যানুয়াল ব্যবস্থায় ট্রেন চালাতে গিয়েই এ দুর্ঘটনা ঘটে। রেলওয়ের ওই সূত্র মতে, ম্যানুয়ালি বা হাতে পয়েন্টস ঠিক করে অনেক সময় ট্রেন পরিচালনা করা হয়। সেক্ষেত্রে সংকেত ব্যবস্থায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা স্টেশন মাস্টারকে আগেই বিষয়টি অবহিত করেন। তখন মাস্টার লোক পাঠিয়ে পয়েন্টস ঠিক করেন। আলোচ্য দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাস্থলে হয় এই চালু ব্যবস্থা ছিলনা অথবা চালু থাকলেও স্টেশন মাস্টার ও সংকেত দেয়ার কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তার মধ্যে সমন্বয় ছিলনা। এজন্য পুরো ট্রেন পার হওয়ার আগেই স্টেশন মাস্টার স্টেশনের প্যানেল বোর্ডের সুইচ টিপে দিক পরিবর্তন করে দিতে পারেন। বলা বাহুল্য, ব্যাপারটি যদি এরকমই হয়ে থাকে তবে বলতেই হবে, এই দুর্ঘটনা ও হতাহতের জন্য সংশ্লিষ্টদের অসতর্কতা ও অবহেলাই দায়ী। আশা করা যায়, তদন্তে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে।
রেলওয়ে, ট্রেন ও যাত্রীসেবার উন্নয়নের অনেক কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনছি। এসব কথা গালগল্পের মতোই মনে হয়। কারণ, উন্নয়নের কোনো প্রমাণ বাস্তবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। অন্যান্য ক্ষেত্রের উন্নয়নের মতো এ ক্ষেত্রের উন্নয়নও ফাঁকা বুলি মাত্র। যদি কথা অনুযায়ী সত্যিসত্যিই উন্নয়ন হতো, তাহলে ট্রেন চলাচল শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হতো, নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো এবং যাত্রীসেবা বাড়তো। এসবের ফলাফল হিসাবে রেলওয়ের প্রতি মানুষের নির্ভরতা ও আগ্রহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতো। বলতে গেলে, নিতান্ত নিরূপায় হয়েই মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করে। এ যাতায়াতে নিরাপত্তার অভাব আছে, ঝুঁকি আছে। প্রায়ই ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এতে কখনো জানমালের ক্ষতি হয়, কখনো হয়না। এটা অনেকটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অনেক রুটেই লাইনের অংশ বিশেষের অবস্থা খুবই শোচনীয়। কোথাও কোথাও লাইনের নীচের পাটতন যথাযথ অবস্থানে নেই। কোথাও কোথাও পাথর নেই বা কম আছে। কোথাও কোথাও লাইনও শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ নয়। লাইনের এসব ত্রæটিপূর্ণ অংশে দুর্ঘটনা বা ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। লাইন সংস্কার ও তার তদারকি ব্যবস্থায় এই অমনোযোগ ও অবহেলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ট্রেনে যাত্রীনিরাপত্তা অত্যন্ত ভঙ্গুর। প্রায়ই ট্রেন থেকে পড়ে যাত্রীর মৃত্যু হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। বিশেষ কিছু এলাকায় এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা বেশী ঘটতে দেখা যায়। নিষিদ্ধ হলেও অনেক সময় যাত্রীদের ট্রেনের ছাদে ওঠে যাতায়াত করতে দেখা যায়। জামালপুর কমিউটার ট্রেনেও অনেকে যাত্রী ছাদে ছিল। তারাই বেশী হতাহত হয়েছে। এর আগে নওগাতে ছাদে ভ্রমণকারীদের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হওয়ার ঘটনা তো আকসারই ঘটতে দেখা যায়। গত রোববার কুষ্টিয়ার পোড়দহ স্টেশনে মোটর সাইকেল আরোহী দুই স্কুলছাত্র ট্রেনের ইঞ্জিনের চাকার নীচে কাটাপড়ে নিহত হয়েছে। শাটলট্রেনের ইঞ্জিন ঘোরানোর সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। লাইন ও স্টেশনগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে কতটা এলোমেলো, এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি তার প্রমাণ বহন করে।
লাইনের, ট্রেনের, যাত্রী সেবার প্রভুত উন্নতি হয়েছে, এটা মুখে বললেই হবে না। কার্যক্ষেত্রে তার প্রমাণ দিতে হবে। ট্রেন পরিচালনাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তার প্রতিফলন থাকতে হবে। রেলওয়ের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। রেলওয়ে সবচেয়ে নিরাপদ, সাশ্রায়ী ও পরিবেশবন্ধব পরিবহন মাধ্যম হিসাবে পরিচিত। বিশ্বজুড়েই রেলওয়ের গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আমাদের দেশে তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। অতীতে নানা কারণে রেলওয়ে অমনোযোগ ও উপেক্ষার শিকার হয়েছে। কিন্তুু বাস্তবতা এই যে, রেলওয়েকে অবহেলা করা আজকের দিনে মোটেই সম্ভব নয়। রেলওয়েকে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে ও প্রয়োজনেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের রেলওয়েমুখী করে তুলতে হবে। এটা করতে হলে রেলওয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন, সংস্কার ও আধুনিকায়নে জোর দিতে হবে। ট্রেনকেও একইভাবে উন্নত ও আধুনিক করে তুলতে হবে। এইসঙ্গে ট্রেন পরিচালনাসহ গোটা রেলওয়ে ব্যবস্থাপনা ত্রæটিমুক্ত ও গতিশীল করতে হবে। যাত্রীনিরাপত্তা ও যাত্রীসেবার প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগও দিতে হবে সঙ্গতকারণেই। ট্রেনদুর্ঘটনা ও ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষ নিহত হওয়ার দায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যেতে পারে না। দায় যাত্রীদেরও আছে। তাদের সচেতনতা , সর্তকতা ও অভিজ্ঞতার অভাব অনেক সময়ই তাদের জন্য মর্মান্তিক পরিণতি বয়ে আনে। কাজেই তাদেরও সাবধান হতে হবে। যাত্রীসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রচারমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারে। দায়িত্বশীলতা দুর্ঘটনা এড়াতে সাহায্য করে। এই দায়িত্বশীলতা রেলওয়েতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেমন থাকতে হবে, তেমনি থাকতে হবে যাত্রীদেরও।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন