বাংলাদেশে স্বৈরশাসকের কবল থেকে গণমানুষের অধিকার আদায় ও নির্বাসিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে বেগম জিয়া এ গণতন্ত্রের মজবুত ভিত নির্মাণ করে অসামান্য অবদান রাখেন। তার এই অবদানের জন্য জাতি চিরদিন তাকে স্মরণে রাখবে। তিনি দীর্ঘ নয় বছর রাজপথে থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আপোসহীন থেকেছেন। তার এই আপোসহীন সংগ্রাম স্বৈরশাসনমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে। তিনি ওইভাবে নেতৃত্ব না দিলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র মুক্তি পেত কিনা সংশয় রয়েছে। লিবিয়া, মিশর, সিরিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি দেশের মতো হয়তো স্বৈরশাসক যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকত ও জনগণের কণ্ঠরোধ করে রাখত। ৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে ও গণতন্ত্র মুক্তি পায়। স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলন সম্পর্কে অনেকে অনেকভাবে লিখেছেন। আমি নিজেও এ বিষয়ে কয়েকটি লেখায় ইঙ্গিত দিয়েছি। দীর্ঘ নয় বছর রাজপথে থেকে আপোসহীনভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। মানুষ তাকে পুরস্কৃত করেছে। আমরা আশা করেছিলাম, তিনি যে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন, তা অব্যাহত থাকবে। তত্ত¡াবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে থাকলে একসময় গণতন্ত্র বলবান ও শক্তিশালী হবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষকে আর ভোগান্তি পোহাতে হবে না। অথচ দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো, সর্বগ্রহণযোগ্য ও দেশ-বিদেশে বহুল প্রশংসিত একটা সুন্দর ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে একদলীয় বা একপক্ষীয় নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করেছে। আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক দল বলে নিজের পরিচয় দিতে গর্ববোধ করলেও কর্মকান্ডে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদীতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। তার কর্মকান্ডে বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। গণন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একপক্ষীয় শাসন পাকাপোক্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। বেগম জিয়াকে ও বিএনপিকে টার্গেট করে আওয়ামী লীগ অগ্রসর হয়েছে। বেগম জিয়ার মামলার বিষয়টি মুখ্য নয়। তার অপরাধ তিনি একটি সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি করছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, বেগম জিয়া নাকি ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে বলেন। এসব আজগুবি ও উদ্ভট ধারণা তারা কোথায় পান, কী দেখে বা শুনে এসব আঁচ অনুমান করেন, জানি না। বেগম জিয়ার দাবির মূল চেতনা হলো দেশের মানুষ যাতে নির্বিঘেœ-নিশ্চিন্তে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারে। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া, আগের রাতে বাক্স ভরাট করে রাখা প্রভৃতি অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ কর্মকান্ড যেন নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে। মানুষ যেন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে ও ভোট দিতে পারে। সরকার কিন্তু এ বিষয়ে কর্ণপাত না করে বেগম জিয়া ও বিএনপির দাবির নানারকম অপব্যাখ্যা দিচ্ছে। বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে তার একটি অপকৌশল হলো বেগম জিয়াকে জেলখানায় আটকে রেখে ২০১৪ সালের মতো একপক্ষীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। তারা এটাও ভালো করে জানে যে, বেগম জিয়া সুষ্ঠু পরিবেশ না পেলে নির্বাচনে আসবেন না। তাই বেগম জিয়ার জামিন নিয়ে তামাশার নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। নানা তামাশায় পর ৮ মে পর্যন্ত জামিন স্থগিত রাখা হয়েছে। ২০ মার্চ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। আপিল বিভাগ দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা লিভ টু আপিল গ্রহণ করেন। তার জামিন নিয়ে নাটক করে সরকার বিএনপি নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ও আবেগকে বার বার উস্কে দিচ্ছে। সরকার যেন চাচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীরা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিক। তাতে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক নেগেটিভ প্রচারণা চালানোর সাথে নির্মম, নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করে আন্দোলন দমানো সহজ হবে। বিএনপির নেতাকর্মীরা অত্যাচার, নির্যাতন ও মামলা হামলায় জর্জরিত হয়ে আর ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি মুখে আনবে না। কিন্তু বার বার উস্কে দিয়েও বিএনপি নেতাকর্মীদেক ফাঁদে ফেলতে না পেরে সরকার হতাশ। সরকার মুখে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা না দেবাার ঘোষণা দিলেও কার্যক্ষেত্রে বাধা দিয়েই যাচ্ছে। বেগম জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি থেকে প্রায় ৫০ জন লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। জাকির হোসেনকে ধরে নিয়ে গিয়ে এমন নির্যাতন করা হলো যাতে তরতাজা যুবকটি মৃত্যুবরণ করল। আন্দোলন থেকে ধরে নিয়ে অত্যাচার নির্যাতন করা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সরকার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা না দিয়ে সহায়তা করার ঘোষাণাটি ¯্রফে কথার কথা।
আমি দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কারণে রাজনীতির একজন ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক এবং বর্তমানে সক্রিয় রাজনীতিক। আমি এ রকম অবিচার ও বিমাতাসুলভ আচরণ কখনও লক্ষ করিনি। বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিএনপি নেতাকর্মীদের উপর যেভাবে বিমাতা সুলভ আচরণ করা হচ্ছে তা দেখে হতবাক ও বিস্মিত হচ্ছি। ৫ বছর বা তদোর্দ্ধ সাজার আসামীকে উচ্চ আদালত সব সময় জামিন দিয়ে আসছেন। এরূপ উদাহরণ বহু রয়েছে। তের বছর সাজা কাঁধে নিয়ে জামিনে থেকে বহাল তবিয়তে মন্ত্রিত্ব করছেন এমন উদাহরণ বাংলাদেশে রয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার পর ১১ তারিখ রবিবার তিনি জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসবেন। আদালত তার বয়স, সামাজিক মর্যাদা প্রভৃতি বিবেচনায় নিয়ে জামিন মঞ্জুর করবেন। কিন্তু আমাদের আশায় গুঁড়ে বালি। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ওই ট্রাস্টের একজন ট্রাস্টিও নন। ওই টাকা তিনি নাড়েননি, ছুঁয়েও দেখেননি অথচ ওই মামলায় তিনি এখন জেলে। তার জামিন নিয়ে তেলেসমাতি কারবার শুরু হয়েছে। কবে তিনি জামিন পাবেন, আদৌ জামিন পাবেন কিনা তা অনিশ্চিত।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ নির্বাচন কমিশনে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন বেগম জিয়া ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না। তাদের দাবির যৌক্তিকতা অনেক। চালক ছাড়া গাড়ি চলে না, আর যদি জোর করে চালানো হয়, দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। দুটো সিটি নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে ও কিছু দাবি জানাতে বিএনপি নেতৃবৃন্দ ১৭ এপ্রিল সিইসির সাথে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে দলের নেতৃত্বদানকারী স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে মানুষের মাঝে উৎকণ্ঠা রয়েছে। সকলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। আমরা ড. মোশাররফ হোসেনের কথাকে পুরাপুরি সমর্থন করে বলতে চাই, বেগম জিয়া বিএনপির প্রাণ ও চালিকা শক্তি। তাকে বন্দি রেখে এদেশের মানুষ কিছুতেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। বেগম জিয়াকে ছাড়া জোর করে আর একটি ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন করলে সেটি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক বিশে^র মনোভাব বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে ও পাচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আমরা বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনীতির সুযোগ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছি। তিনি মাঝে মধ্যে মহাসচিবের পক্ষে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রত্যাশা- অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশে একটি পরিবেশ গড়ে উঠবে। অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ বর্তমান নেই। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সন জেলখানায়, নেতাকর্মীরা অবাধে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে না, তারা গুম, খুন, গ্রেফতার, আতংক ও মামলা, হামলায় জর্জরিত, রাজনৈতিক কারণে দমন-পড়ীন, নির্যাতন ও মামলা-হামলায় জেলখানা, আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে ব্যস্ত, সরকারি দলের নেতাকর্মীরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো রাজনৈতিক ময়দান চষে বেড়াচ্ছে বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্ববাসী এ সবকিছু অবগত। সে কারণে জাতিসংঘের মহাসচিব অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ গড়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা করছেন। শুধু জাতিসংঘ নয়, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বের ক্ষমতাধর, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকার সংগঠন থেকে মাঝে মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জানানো হচ্ছে। সকলের প্রত্যাশা, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হোক। এ জন্য বেগম জিয়ার আশু মুক্তি অপরিহার্য। তাকে মুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষ পরিবেশ ও সকল দলের জন্য সমতল মাঠ তৈরি করে নির্বাচনে অগ্রসর হওয়া দরকার। বেগম জিয়া বিদেশ ভ্রমণে পারদর্শী না হলেও দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ চিন্তায় পারদর্শী। দেশের মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। তাকে নিয়ে টানা-হ্যাচড়া না করে, বৃদ্ধ বয়সে জেলখানায় বন্দি রেখে কষ্ট না দিয়ে তাকে জামিন দেয়া হোক দেশবাসীর এটিই প্রত্যাশা। জামিন পাওয়া তার অধিকার।
এ দেশের গণতান্ত্রিক শাসন প্রণয়নে ও টিকিয়ে রাখতে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার অবদান অসামান্য। শহিদ জিয়া একদলীয় শাসনের নাগপাশ মুক্ত করে বহুদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। কিন্তু বেগম জিয়ার উপর দু’বার গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পড়েছে। ৯ বছর স্বৈর শাসনের বিরোধিতা করে ও আন্দোলন সংগ্রাম করে তিনি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। তার আন্দোলনের ফসল গণতান্ত্রিক শাসন। তার চোখের সামনে গণতান্ত্রিক শাসনের বদলে একপক্ষীয় শাসন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে কারণে তিনি পুনরায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। একাজে প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বেগম জিয়ার পাশে থাকা। একটু আপোস করলে বোধ হয় এই বৃদ্ধ বয়সে তাকে জেলখানার প্রকোষ্টে থাকতে হতো না। কিন্তু তিনি আপোসের পথে যাননি। সংগ্রামের বন্ধুর পথ বেছে নিয়েছেন। এ সংগ্রামে তিনি জয়ী হবেন, দেশবাসীর এটাই দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: প্রফেসর (অব.), দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন