শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

সউদী কর্মস্থলে নিরাপত্তার অভাব অভিবাসী নারী কর্মীরা পালাচ্ছে

মান-ইজ্জত না বাঁচলে বিদেশে থাইক্ক্যা লাভ কী? মমতাজ

| প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

অভিযুক্ত নিয়োগকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি
শামসুল ইসলাম : সউদী আরবের কতিপয় কর্মস্থলে নিরাপত্তার অভাবে শত শত নারী কর্মী পালিয়ে দূতাবাসের সেইফ হোমে ও সউদী সফর জেলে আশ্রয় নিচ্ছে। সউদী নিয়োগকর্তারা এসব নারী কর্মীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা পরিশোধ এবং প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করেনি বলে অভিযোগ উঠছে। নির্যাতনের শিকার প্রত্যাগত নারী কর্মী মমতাজ বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, নিজের মান-সম্মান ও ইজ্জত না বাঁচলে বিদেশে থাইক্ক্যা লাভ কি ? তিন মাসের বেতন রেখেই সে পালিয়ে রিয়াদস্থ বাংলাদেশী সেইফ হোমে আশ্রয় নেয়। গাইবান্ধার মমতাজ বেগম গত ২০ এপ্রিল এয়ার এরাবিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট যোগে সউদী থেকে দেশে ফিরেছেন। একই ফ্লাইটে সর্বমোট ৩৩ জন নারী কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে খালি হাতে দেশে ফিরেছে। গত ৫ মার্চ নির্যাতনের শিকার ২৬ জন নারী কর্মী সউদী আরব থেকে দেশে ফিরেছে। সউদী আরবের কয়েকটি সেইফ হোম ও সউদী ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার আরো কয়েকশ’ নারী কর্মী দেশে ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রত্যাগত নারী কর্মীরা এতথ্য জানিয়েছেন। মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সি’র মালিকরা বলেছেন, সউদী আরবে ৯০% মহিলা গৃহকর্মী ভালো আছে। ১০% মহিলা গৃহকর্মী হোম সিকনেসসহ বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরছে বলেও তারা দাবী করেন। গত জানুয়ারী থেকে গত ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সউদী আরব থেকে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রায় ১ হাজার নারী কর্মী খালি হাতে দেশে ফিরেছে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের আর্থিক সহায়তায় নির্যাতনের শিকার নারী কর্মীরা সউদী আরব থেকে দেশে ফিরছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র এতথ্য জানিয়েছে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্র্তৃপক্ষ সেইফ হোমে আশ্রিত নারী কর্মীদের দেখভাল করতে এবং দেশে ফেরত পাঠাতে হিমসিম খাচ্ছে।
বিএমইটি’র সূত্র জানায়, গত জানুয়ারী থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সউদী আরবে ৮৫ হাজার ১শ’ ৫৮ জন নারী-পুরুষ কর্মী চাকুরি লাভ করেছে। উল্লেখিত সময়ে এর মধ্যে ২১ হাজার ৬শ’ ১০ জন নারী কর্মী সউদী আরবে গেছে। এসময়ে দেশটি থেকে প্রবাসী কর্মীরা ৬শ’৫৩ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছে। গত জানুয়ারী থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশটি থেকে প্রায় ১ হাজার নারী কর্মী খালি হাতে দেশে ফিরেছে। দেশটিতে ১৯৯১ সাল থেকে গত মার্চ মাস পর্যন্ত ২ লাখ ২৬ হাজার ৩শ’ ৩৯ জন নারী কর্মী চাকুরি লাভ করেছে। একই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২ লাখ ২৬ হাজার ৪শ’ ৭৮ জন নারী কর্মী, জর্ডানে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮১ জন নারী কর্মী, লেবাননে ১ লাখ ৪ হাজার ৬শ’ ৪৪জন নারী কর্মী , ওমানে ৬৭ হাজার ২শ’ ৮১ জন নারী কর্মী এবং কাতারে ২৬ হাজার ৬শ’ ৯৪ জন নারী কর্মী চাকুরি লাভ করেছে। বিগত ২০১৫ সাল থেকে সউদী আরবে পুরোপুরি নারী কর্মী যাওয়া শুরু হয়। সউদীতে মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো প্রত্যেক নারী কর্মী’র প্রসেসিং কমিশন বাবদ ১ হাজার মার্কিন ডলার করে পাচ্ছে। এতে মহিলা প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা আয় করছে। বায়রার যুগ্ন-মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান ইনকিলাবকে বলেন, সরকারী হিসেবে গত তিন বছরে সউদী থেকে ৪ হাজার মহিলা গৃহকর্মী দেশে ফিরেছে। আসলে হোম সিকনেস, স্বাস্থ্যগত কারণ, খাদ্যাভাস, শিক্ষিত না হওয়া এবং শারীরিক দক্ষতার অভাবে ১০% থেকে ১২% মহিলা গৃহকর্মী সউদী থেকে দেশে ফিরছে। এক প্রশ্নের জবাবে নোমান বলেন, সউদীতে কিছু কিছু মহিলা গৃহকর্মী নির্যাতিত হচ্ছে। নির্যাতনের বিষয়টি সব জায়গাতেই হচ্ছে। আমাদের দেশে দরিদ্র মহিলা কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি না। ভালো ট্রেনিং দেয়া , শিক্ষিত মহিলাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদেশে প্রেরণ এবং শারীরিক দক্ষতা সম্পন্ন মহিলা গৃহকর্মী সউদীতে পাঠাতে পারলে কর্মী’র বেতনও বাড়বে। নির্যাতনের শিকার মহিলা গৃহকর্মীরা দ্রæত দেশে ফেরার কারণে অভিযুক্ত নিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও সম্ভব হয়ে উঠছে না বলে বায়রার নেতা নোমান উল্লেখ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দূতাবাসের সেইফ হোমে ও সউদী ইমিগ্রেশন জেলে আশ্রিত নারী কর্মীদের অনেকেই নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ নারী কর্মীদের এসব সমস্যার বিষয় সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে একাধিক লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে। সউদী নিয়োগকর্তারা কেউ কেউ দায় এড়াতে সেইফ হোমে আশ্রিত অভিবাসী নারী কর্মীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ ষ্টেশনে মামলা ও জিডি দায়ের করছেন। সউদী আরবে অভিবাসী নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং তাদের অধিকার সুরক্ষায় অভিযুক্ত সউদী নিয়োগকারীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবীও উঠছে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম হেড শরিফুল হাসান ইনকিলাবকে বলেন, সউদী আরবে কর্মরত বাংলাদেশী নারী কর্মীদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। সউদীতে নির্যাতিত অভিবাসী নারী কর্মীদের ঘটনাসমূহ তদন্ত করা সরকারের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। তিনি অভিবাসী নারী কর্মী নির্যাতনকারী সউদী নিয়োগকারী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচারের জোর দাবী জানান।
বায়রার সাবেক যুগ্ন-মহাসচিব-১ আলহাজ আবুল বাশার ইনকিলাবকে বলেন, সউদী আরবে মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণের বিষয়টি পুরোপুরি দালাল নির্ভর হওয়ায় দেশে ফেরার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। দালালরা মহিলা কর্মীদের শিখিয়ে দেয় সউদীতে যাওয়ার তিন মাস পর দেশে ফিরে আসতে। এর পর তারা সউদী ফেরত মহিলা কর্মীকে পুনরায় রিক্রুটিং এজেন্সি’র কাছ থেকে ২০/২৫ হাজার টাকা কমিশন পেয়ে দুবাই, কাতার জর্ডানে পাঠাচ্ছে। এছাড়া হোস সিকনেস-এর কারণেও কিছু কিছু মহিলা গৃহকর্মী সউদী থেকে ফিরছে বলে আবুল বাশার উল্লেখ করেন। এতে মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এবং সউদী নিয়োগকর্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশী মহিলা গৃহকর্মীর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তিনি বলেন, এ শ্রমবাজার ধরে রাখতে হলে দালাল চক্রের অপতৎপরতা বন্ধের লক্ষ্যে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবী জানান। তিনি মানবপাচার আইন-২০১২-এর কালো ধারা সংশোধন করে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে তাদের অধিকার রক্ষায় কার্যকরী উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
ফিমেল ওয়ার্কাস রিক্রুটিং এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফরাব)-এর আহবায়ক আফতাব উদ্দিন চৌধুরী গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সউদী আরবে ৯০% মহিলা গৃহকর্মী ভালো আছে। বিনা খরচে সউদী গিয়ে মহিলা গৃহকর্মীরা প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করছে। মহিলা গৃহকর্মীরা প্রচুর রেমিটেন্স দেশে পাঠাচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোও মহিলা গৃহকর্মী পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মূদ্রা আয় করছে। হোম সিকনেস এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় ১০% মহিলা গৃহকর্মী দেশে ফিরছে। সউদী থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার মহিলা গৃহকর্মীর সংখ্যা খুবই কম বলে তিনি উল্লেখ করেন।গত ১৪ মার্চ রিয়াদে সউদী-বাংলাদেশ-এর যৌথ টেকনিকেল কমিটি’র বৈঠকে বাংলাদেশী মহিলা গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতন-নিপীড়নের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে বলেও আফতাব উদ্দিন চৌধুরী উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে সউদী কর্র্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, বর্হিবিশ্বের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সিন্ডিকেটের তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। কোনো সিন্ডিকেট তৈরি হলেই প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারের অন্তরায় হয়। সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিই যাতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিধিমালা অনুসরণ করে জনশক্তি রফতানি করতে পারে তার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখার ওপরগুরুত্বারোপ করেন আফতাব উদ্দিন চৌধুরী। আগামী ২৪ এপ্রিল স্থানীয় একটি হোটেলে আয়োজিত সভায় ফিমেল ওয়ার্কার্স রিক্রুটিং এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর আহবায়ক পদ থেকে অব্যহতি দেয়ারও তিনি আভাস দেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন